সাইফুল হক মিঠু

কাজল কায়েস
  ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪১

উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০ লক্ষাধিক জেলের গলার কাঁটা ঋণ-দাদন। এ পেশায় রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, দুঃখ-কষ্ট-আহাজারি। মরেও রক্ষা হয় না। পরিবারকেই টানতে হয় ঋণের বোঝা। দেশের জেলে সুরক্ষা আইনটিও সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত নয়। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় ঠিকমতো পৌঁছায় না প্রণোদনা। এ পেশার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নেই সরকারের কোনো পরিকল্পনা। জেলেদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি কাজল কায়েসের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।

চাঁদপুরের চরভৈরবীতে পাউবোর বেড়িবাঁধের পাড়াবগুলার বাসিন্দা মোশারফ মালাকার (৫৫) মারা যান গত ১ জুলাই। তিনি নদী-সমুদ্রে মাছ ধরতেন। তার কাছে চরভৈরবী মাছঘাটের আড়তদার নজরুল ইসলাম ফকিরের দাদন রয়েছে দেড় লাখ টাকা। সমিতি, স্থানীয় দোকানিসহ কয়েক ব্যক্তি আরও লাখ দুয়েক টাকা পান।

মোশারফের স্ত্রী ফরিদার দাবি, এসব দেনার টেনশনেই মারা গেছেন তার স্বামী। এখন পাওনাদাররা তাদের খুঁজে বেড়ায়। সন্তানদের নিয়ে সরে সরে থাকতে হয়।

জেলেরা যেন জন্মগতভাবেই বঞ্চিত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। হাতে গোনা কিছু ছাড়া দেশের সব জেলেই আজীবন ঋণের জালে জর্জরিত। অনেক স্থানে মৃত্যুর পর মরদেহ দাফনেও বাধা দেন পাওনাদাররা।- জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি রায়পুর উপজেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা বেপারী

বছরের শুরুতেই মারা গেছেন ভোলার চরফ্যাশনের মাইনুদ্দিন ঘাট এলাকার জেলে শরীফ জমাদ্দার (৫৮)। তিনি চাঁদপুর, ভোলা, লক্ষ্মীপুরের কয়েকটি আড়ত থেকে অন্তত ১০ লাখ টাকা দাদন নিয়েছিলেন। অথচ মৃত্যুর পর শরীফের স্ত্রী হনুফাকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় লোকজন চাঁদা তুলে তার দাফন-কাফন শেষ করেন।

ক্ষোভে-দুঃখে জাগো নিউজকে হনুফা বলেন, ‘হের লগে অ্যাঁই মইরলে ভালা হইতো (তার সঙ্গে আমিও মারা গেলে ভালো হতো)। কৈরতন দিয়াম মাইনষের টিয়া? (কোথা থেকে দেবো মানুষের টাকা?)।’

নোয়াখালীর হাতিয়ার জাহাজমারার প্রবীণ জেলে লতিফ মাঝি সম্প্রতি মারা যান। জেলেদের মধ্যে বলাবলি আছে, জন্মের পর থেকেই লতিফ ছিলেন দেনাদার। অন্তত ২৫ লাখ টাকার ঋণ শোধ করার দুশ্চিন্তায়ই তিনি ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন।

দাদন চক্রের কাছে ইলিশ আর জেলেদের জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। দাদন, আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগী চক্র নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।- ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান

ঋণের বোঝা নিয়েই মারা যান অধিকাংশ জেলে। এটি শুধু লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, নোয়াখালীতেই নয়, বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলায়ই কম-বেশি একই চিত্র। এই জনপদে ১০ লক্ষাধিক জেলের বসবাস। এর মধ্যে অল্প সংখ্যক জেলেই পাওয়া যাবে যাদের কোনো দেনা নেই!
 
শৈশব থেকেই বাবা বা পরিবারের অন্যদের সঙ্গে জীবিকার তাগিদে নদী-সমুদ্রে যাওয়া-আসা এদের। শক্ত হাতে বৈঠা ধরা, জাল ফেলার কৌশল রপ্ত করলেও একেকজন জেলে যেন জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। সময়ের পরিক্রমায় বৃদ্ধ বয়সে শরীরের সঙ্গে চামড়া লেপ্টে থাকলেও যেন শেষ হয় না এই জীবনযুদ্ধ। পরে একসময় মরেও রক্ষা হয় না। ঋণের বোঝায় পিষ্ট হতে থাকে পরিবার-পরিজন।
 
গত ৩ অক্টোবর দুপুরে তীব্র রোদের মধ্যে পাউবোর বেড়িবাঁধের লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের চরবংশীর হ্যাচারিঘাটের অংশে এক বৃদ্ধ নারী মোটরসাইকেল থামানোর সংকেত দিলেন। কাছে এসে বললেন, ‘আপনারা কোন সমিতির? আমি কোনো ত্রাণ পাই নাই, বাবা!’

বৃদ্ধার নাম বুলি বেগম (৫৫), থাকেন চর কাচিয়া। স্বামী মোক্তার ছয় লাখ টাকা দেনা রেখে মারা গেছেন বছরখানেক হলো। শ্বশুর মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। তিনিও দেনা রেখে যান। নদীতে মাছ ধরে মোক্তার সেই টাকা পরিশোধ করেন। এখন বৃদ্ধা থাকেন অন্যের জমিতে ঘর তুলে। ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। স্বামীর দেনার চিন্তায়ও শান্তি নেই তার।

রায়পুরের বড়নাইয়া বাড়ির জেলে আজিজ দেওয়ান (৬৫) পাঁচ সন্তান রেখে গত রমজানে মারা গেছেন। আগের দিনও তিনি নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী নাজমা বেগমের কাছে জানা যায়, ট্রলারমালিক বাবুল মাঝি আর দাদনদার নাসির খাঁর চার লাখ, এনজিও-সমিতির দেড় লাখ টাকা দেনা আছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বর্ণনার এক ফাঁকে নাজমা বেগম বলেন, ‘কী করার আছে! সন্তানদেরই আস্তে আস্তে দেনা শোধ দিতে হবে।’

বড় নাইয়াবাড়ির জেলে জয়নাল উদ্দিন বেপারী ২০২১ সালের শুরুতে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মারা যান। তিনি ২৫ লাখ টাকা দেনা ছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে অন্যের জমিতে ঘর করে ছয় সন্তান নিয়ে থাকতেন জয়নাল। মৃত্যুর ১৩ মাস পর স্কুলপড়ুয়া ছেলে নীরব নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যায়।

জয়নালের আরেক ছেলে ফরহাদ জাগো নিউজকে বলেন, বাবার মৃত্যুর পর পাওনাদাররা টাকার জন্য লাশ আটকে রেখেছিল। ভাই নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে মারা গেলো। সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।

ঋণগ্রস্ত হয়ে মারা যাওয়া জেলেদের পরিবারে এভাবে নেমে আসে নির্মম-অমানবিক পরিস্থিতি। মাছঘাটের আড়তদার, মহাজন, গ্রাম্য সুদ কারবারি, সমিতি, এনজিওর ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে প্রায় সব জেলে পরিবারই জড়িত। মৃত্যুর পর মরদেহ আটকে রাখা, দাফন-কাফন-জানাজায় বাধা দেওয়া, পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে যাওয়া, মারধর-হুমকি, খালি স্ট্যাম্পে সই রাখা, মামলায় আসামি করার ঘটনা ঘটছে অহরহ।

জেলেরা জানান, আশির দশকের আগ পর্যন্ত মূলত নদীতে ছোট পালতোলা নৌকা দিয়েই মাছ ধরা হতো। তখন কোনো দাদন-ঋণ ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৮০ সালের পর থেকে এসব শুরু হয়। তখন গভীর সমুদ্রে বেশি মাছ পাওয়া যায় বলে জেলেদের ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রয়োজন হয়। তখনকার দিনে একেকটি নৌকা বানাতে ও জাল-সরঞ্জামসহ সাজাতে দুই থেকে তিন লাখ টাকা লাগতো। তখন আড়তদার, মহাজনদের মতো পুঁজিপতিরা দাদন বা ঋণ দিয়ে জেলেদের সমুদ্রে পাঠানোর ব্যবস্থাও করতেন। তারা সমুদ্রে গিয়ে প্রচুর মাছ পেতেন এবং সবাই লাভবান হতেন।

১৯৮৫ সালে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক)’ প্রথমবারের মতো ‘উপকূলীয় জেলেদের অধিকার সংরক্ষণ ও আর্থ-সামাজিক জীবনমান উন্নয়ন’ কার্যক্রম শুরু করে। তারাই প্রথম সমিতি গঠনের মাধ্যমে জেলেদের কাছে যায়; স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন দেখিয়ে ঋণ নিতে উৎসাহিত করে। পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন এনজিও-সমিতির প্রসার ঘটে এবং জেলেরা ধীরে ধীরে আবদ্ধ হয়ে পড়েন ঋণজালে। শুরু হয় মাছ শিকারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নির্বিচারে চলতে থাকে পোনা-জাটকা-মা মাছ নিধন।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। মানুষের অবিবেচক তৎপরতার পাশাপাশি চলতে থাকে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। দেশের নদী-সাগরের সীমানায় কমতে থাকে মাছের আনাগোনা। জেলেদের জালে দেখা দেয় মাছের আকাল। প্রায়ই শূন্য হাতে ফিরতে হয় তাদের। অভাবগ্রস্ত হয়ে দায়-দেনা আরও বাড়তে থাকে। তখন, আশির দশকে ট্রলারে লাগতো দুই-তিন লাখ টাকা, এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ৪০-৫০ লাখে।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির রায়পুর উপজেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা বেপারী বলেন, জেলেরা যেন জন্মগতভাবেই বঞ্চিত। প্রজন্মের পর প্রজম্ম তাদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। হাতে গোনা কিছু ছাড়া দেশের সব জেলেই আজীবন ঋণের জালে জর্জরিত। অনেক স্থানে মৃত্যুর পর মরদেহ দাফনেও বাধা দেন পাওনাদাররা। নির্দলীয়ভাবে তালিকা করে পুনর্বাসন ও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব।