শিরোনাম
উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০ লক্ষাধিক জেলের গলার কাঁটা ঋণ-দাদন। এ পেশায় রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, দুঃখ-কষ্ট-আহাজারি। মরেও রক্ষা হয় না। পরিবারকেই টানতে হয় ঋণের বোঝা। দেশের জেলে সুরক্ষা আইনটিও সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত নয়। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় ঠিকমতো পৌঁছায় না প্রণোদনা। এ পেশার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নেই সরকারের কোনো পরিকল্পনা। জেলেদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি কাজল কায়েসের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথমটি।
টানা তিন মাস পর ঘরে ফিরেছেন নাজির মাঝি। মুখভরা হাসি, ব্যাগ ভরা টাকা আর থলে ভরা বাজার-সদাইয়ের বদলে তিনি এসেছেন খালি হাতে। অথচ সুখের জীবন বলতে যা বোঝায়, তার সবই ছিল নাজিরের।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার জেলেপল্লি উত্তর চরবংশীর নাইয়াপাড়ার বড় নাইয়া বাড়িতে ছিল তার সংসার। নিজের আয়ের পাশাপাশি আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে প্রায় ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ট্রলার বানান। কেনেন জালসহ অন্য সব সরঞ্জাম। সেটা নিয়েই নদী-সাগরে মাছ ধরে চালাতেন জীবন। কিন্তু বছর দুয়েক আগে নাজিরের মাছধরার ট্রলারটি ইঞ্জিনসহ জ্বলে নষ্ট হয়। পাল্টে যেতে থাকে তার জীবনের অধ্যায়।
নাজির মাঝি আবার হাত পাতেন অন্য আড়তদারের কাছে। তিনজনের কাছ থেকে দাদন নেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তাতেও কুলায় না। স্ত্রী হাওয়া বেগমকে দিয়েও সমিতি-এনজিও মিলিয়ে সাতটি সংস্থা থেকে আরও ২২ লাখ টাকা ঋণ নেন। গড়ে তোলেন আরেকটি ট্রলার। কিন্তু এখন আগের মতো মাছ ওঠে না জালে। আয়-রোজগার প্রায় শূন্যের কোঠায়।
গত ১০ অক্টোবর খালি হাতে বাড়ি ফেরার পরের দিন বিকেলে ঘটে আরেক ঘটনা। রায়পুরের চরপাগলা গ্রামের সুদ কারবারি কামাল ২৫-৩০ জন লোক নিয়ে এসে নাজিরের ছেলে রিয়াদকে (২৪) ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায়। তার অপরাধ ৭৫ হাজার টাকা দাদন নিয়ে এক লাখ ২৫ হাজার দিয়েছেন। এখনো ৫০ হাজার টাকা পাওনা দাবি। মারধর করা হচ্ছে শুনে রিয়াদকে দেখতে গেলে পিটুনির শিকার হন আত্মীয় আক্তার হোসেনও। পরে সেনাবাহিনী, পুলিশের হস্তক্ষেপে রিয়াদকে উদ্ধার করা হয়।
জানতে চাইলে সুদ কারবারি কামাল বলেন, ‘রিয়াদ দুই-তিন বছর আগে টাকা নেওয়ার পর প্রথমে কথামতো পরিশোধ করেছিল। তার কাছে এখনো ৫০ হাজার টাকা পাওনা। কিন্তু দিচ্ছিল না। এজন্য তাকে ধরে এনেছি। মারধর করা হয়নি।’
অফিসাররা কিস্তির জন্য এলে ভাত ফেলেও দৌড়ে পালাই। রাত ১০-১১টা পর্যন্ত তারা বসে থাকেন। চলে গেলে আবার ঘরে আসি। কী করবো-ঋণগ্রহীতা রহিমা
এখানেই শেষ নয়, নাজির মাঝি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোলার চরফ্যাশনের আড়তদার সেলিম ও আসাদ আগের দাদনের ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাওনার কারণে ট্রলার-জালসহ সবই রেখে দিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে তাদের সঙ্গে আমার দেড় কোটি টাকার ব্যবসা হয়। দাদনদাররা কমিশন পান ২৫ লাখ টাকা।’
তিনি জানান, তিন মাস আগে ১৪ জেলেকে নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে ২২ লাখ টাকার মাছ পান। সেই মাছ বিক্রি করে জেলেসহ অন্যদের পাওনা পরিশোধ করার পর বেঁকে বসেন আগের আড়তদার সেলিম ও আসাদ। তারা জোর করে ট্রলার-জাল রেখে দেন। পরে তিনি এলাকার অন্য জেলেদের ট্রলারে করে খালি হাতে ফিরে এসেছেন।’
এখন সমিতি-এনজিওর সাপ্তাহিক কিস্তি আর আড়তদারদের দাদনের টাকার ভাবনা সারাক্ষণ তাড়া করে ফেরে চার ছেলে, তিন মেয়েসহ নাজির-হাওয়া দম্পতিকে।
আরেক দিনের ঘটনা। নাজির মাঝির ঘরে ৮-১০ জন নারী-পুরুষ দাঁড়ানো। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘প্রত্যাশী’র ‘জুঁই’ শাখার (সমিতি) সাপ্তাহিক কিস্তি সংগ্রহ চলছে। এই সমিতির সদস্য ৬৫ জন। মাঠকর্মী আছমা আক্তার একে একে গ্রাহকদের কিস্তির টাকা গুনে নিচ্ছেন ও বইতে লিখছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে নাজির মাঝির স্ত্রী হাওয়া বেগম।
তার কাছে জানা যায়, বিয়ের পরপরই প্রায় ২৫ বছর আগে প্রথমবারের মতো তিনি সদস্য হন কোডেক নামের এনজিওর। তখন পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নেন হাওয়া। সেখান থেকেই ঋণের জালে জড়ানো। ২০১৮ সালে প্রত্যাশী থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিলেও এখন তা দুই লাখে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বছর গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২০ হাজার টাকা নিলেও এখন তা দেড় লাখ। উদ্দীপন থেকে ৪০ হাজার নিলেও এখন চার লাখ, সোপিরেট এনজিও থেকে ৫০ হাজার নিলেও এখন দেড় লাখে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আশায়ও আছে তার দেড় লাখ টাকা দেনা। আবার প্রতিটি সমিতিতে কিছু কিছু সঞ্চয়ও রয়েছে।