শিরোনাম
ভূমিহীনদের জন্য সরকারের নেওয়া গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গাইবান্ধা সদর উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুর রহমানের পদাবনতি হয়েছে। তাঁকে ষষ্ঠ গ্রেড থেকে সপ্তম গ্রেডে অবনমন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে তাঁকে আত্মসাৎকৃত পুরো টাকা নিজের বেতন-ভাতা থেকে পরিশোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত সপ্তাহে এ ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। শফিকুর রহমান বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগে ন্যস্ত আছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অদক্ষতা, অসদাচরণ ও দুর্নীতিপরায়ণতার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী এখন তাঁকে দুই বছর সপ্তম গ্রেডে থাকতে হবে। দুই বছর পর আবার তিনি আগের পদ ফিরে পাবেন। তবে তিনি বকেয়া টাকা পাবেন না।
প্রশাসন ক্যাডারের ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা শফিকুর রহমান (পরিচিতি নম্বর ১৬৩৬২) ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ইউএনওর দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধা সদর উপজেলার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আলী আজম বলেন, গুচ্ছগ্রাম হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পে যিনিই অনিয়ম করবেন, তাঁকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির মধ্যে পড়তে হবে। গাইবান্ধার সাবেক ইউএনও শফিকুর রহমানকে শাস্তি প্রদানের মধ্য দিয়ে অন্যদের কাছে সরকারের শক্ত অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী গুচ্ছগ্রাম (সিভিআরপি) প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় ঘর তৈরি করে ভূমিহীন নাগরিকদের দেওয়া হচ্ছে। গুচ্ছগ্রামের আওতায় গৃহহীনদের জন্য গ্রোথ সেন্টার নির্মাণ, সুপেয় পানির জন্য নলকূপ স্থাপন, পুকুর খননসহ সব ধরনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়নে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করতে হয়। ওই কমিটিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও), সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও রাখতে হয়। কিন্তু গাইবান্ধা সদরের সাবেক ইউএনও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রকল্প কমিটি গঠনই করেননি। জানা গেছে, তিনি প্রকল্পের পুরো কাজই করেছেন একক দায়িত্বে। মাটির কাজ না হওয়া সত্ত্বেও ঘরের জন্য বরাদ্দ করা টাকা উত্তোলন করেছেন। অ্যাকাউন্ট পে চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন না করে নগদ টাকা তুলেছেন। বদলিজনিত কারণে দায়িত্ব হস্তান্তরের পরও তিনি বিধিবহির্ভূতভাবে কাজ চালিয়ে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৫৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা না রেখে গোপনীয় সহকারীর (সিএ) কাছে জমা রেখেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিভাগীয় মামলা হয়। তিনি ব্যক্তিগত শুনানির আবেদন করেন পরের বছরের ২১ জানুয়ারি। একই বছরের ৮ মার্চ তাঁর ব্যক্তিগত শুনানি নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শুনানিতে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এরপর তাঁকে দ্বিতীয় দফায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে সেখানেও তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি।
এরপর শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতামত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পিএসসি থেকেও শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, গাইবান্ধা সদরের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিপরায়ণতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ২০১৮-এর আলোকে তাঁকে দুই বছরের জন্য নিম্নপদে অবনমন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁর বর্তমান ষষ্ঠ গ্রেড (বেতন স্কেল ৩৫,৫৫০-৬৭,০১০) থেকে সপ্তম গ্রেডে (বেতন স্কেল ২৯,০০০-৬৩,৪১০) সহকারী সচিব পদে অবনমন করা হয়েছে। একই সঙ্গে আত্মসাৎকৃত ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮০ টাকা তাঁর বেতন-ভাতা থেকে আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসনসচিব জানান, এ মাস থেকেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এবং আত্মসাৎকৃত টাকা তাঁর বেতন-ভাতা থেকে কাটা শুরু হবে।
জানা গেছে, শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ৫৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। তাহলে তাঁর বেতন-ভাতা থেকে কেন ১০ লাখ টাকা কম, অর্থাৎ ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮০ টাকা কম কাটা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল দুই বছর আগে। পরে সবার সাক্ষ্য গ্রহণের পর দেখা গেল আত্মসাৎকৃত টাকার পরিমাণ ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার। সে জন্য এ সিদ্ধান্ত।
গাইবান্ধা সদর উপজেলায় বর্তমানে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বলেন, ওই সময়কার গোপনীয় সহকারী (সিএ) জোবায়ের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে যোগসাজশ করে সাবেক ইউএনও শফিকুর রহমান অনিয়মগুলো করেছেন।
সূত্র: প্রথম আলো