শিরোনাম
রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোর মতোই ব্যস্ত শাহবাগ ট্রাফিক জোনের কনস্টেবল মং মং ন্যান্ঠ (বাতেন)। দীর্ঘ ১৬ বছর নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকেন মিরপুরে। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা যা-ই থাকুক, প্রতিদিন একই নিয়মে তাকে রাস্তায় নামতে হয়। ইশারায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় দ্রুত ছুটে চলা গাড়িগুলো।
ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা সময়ে বিড়ম্বনার মুখেও পড়তে হয়েছে। শুনতে হয়েছে নানা জনের নানা বাঁকা কথা। ধুলো-বালি আর রোদ-বৃষ্টিতে দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও জ্যামের জন্য শুনতে হয়েছে কটু কথা। কিন্তু সবকিছু তুচ্ছ করে যান ও জনতার চলার গতি স্বাভাবিক রাখতে বাতেনের মতো হাজারো ট্রাফিক পুলিশ মুখ বুজে হয়ে ওঠেন সর্বংসহা।
এই ধুলোর নগরীতে দিনরাত রাস্তায় দায়িত্ব পালনের কারণে ট্রাফিক পুলিশরা ধুলোমাখা অক্সিজেনের প্রথম সারির গ্রাহক। বাতেনও তাদেরই একজন।
সাধারণ পথচারী কিংবা গন্তব্যমুখী মানুষ যেখানে দিনে দু-একবার রাস্তা পারাপারে হিমশিম খান, সেখানে সকাল-সন্ধ্যা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঝ রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের। এতে নানা সময়ে ঘটে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও। কখনো জীবনহানিও ঘটে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। কেউ কেউ আহত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে আবারও দাঁড়িয়ে যান সড়কে। ট্রাফিক পুলিশ বাতেনও এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে অপরিচিত নন।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ২০১২ সালের দিকের ঘটনা। সড়কে দায়িত্ব পালন করছিলাম। ইশারা দেওয়ার পরও একটি বাস আমার পায়ের ওপর উঠে পড়ে। এতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিলাম। সেই বাসচালককে ধরলেও পরে মানবিক বিবেচনায় ছেড়ে দেই। কিছুদিন পায়ের চিকিৎসা করে সুস্থ হই। প্রতিদিন রাস্তায় এত এত শব্দদূষণের মধ্যে থেকে কানে এখন কিছুটা কম শুনি। এতকিছুর পরও জ্যাম বা অন্য কোনো কারণে সিগন্যাল ছাড়তে একটু দেরি হলেই মানুষের গালাগাল নীরবে হজম করতে হয়। সড়কের এ অভিজ্ঞতা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে।
এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ বাতেন যেন গোটা ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত সদস্যদেরই প্রতীকী চরিত্র। বছরজুড়ে ধুলো আর গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নের শব্দ যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। দিন-রাত জনজীবনে সেবা দিতে গিয়ে তারা ভোগেন শ্বাসকষ্ট, সাইনোসাইটিস, মাথাব্যথা, শ্রবণশক্তি হ্রাসের মতো শারীরিক নানা সমস্যায়।
৩১ বছর ধরে রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশের চাকরি করা ফুলবাড়িয়া ট্রাফিক জোনের সহকারী পুলিশ সার্জেন্ট মো. আব্দুল মান্নান বলেন, প্রতিদিন এত ধুলোবালি শরীরে লাগে যে একদিন কাপড় না ধুলেও চলে না। বছরের পর বছর রাস্তার ধুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যেতে যেতে এখন শ্বাসকষ্ট হয়েছে। ওষুধ খাচ্ছি, সারে না। রাতে ঘুমাতে খুব সমস্যা হয়।
বায়ুদূষণের ফলে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশদের অনেকের মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। প্রতিনিয়ত গাড়ির উচ্চশব্দের মধ্যে থাকায় অনেকের স্বভাব ও আচরণ হয়ে ওঠে খিটখিটে। এর প্রভাব পড়ে পরিবার থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে।
ট্রাফিক লালবাগ বিভাগের পুলিশ সার্জেন্ট মো. আহসান হাবিব প্রামাণিক বলেন, শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে বাসায় গিয়ে টিভির সাউন্ডও বেশি দিয়ে শুনতে হয়। এতে বাসার অন্য সদস্যরা মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, প্রতিদিন শুধু ঢাকা মহানগরীতেই চার হাজার সদস্য সড়কের শৃঙ্খলায় দায়িত্ব পালন করছেন। দিনের পর দিন বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।
ট্রাফিক সদস্যদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ অতিমাত্রায়। ফলে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশদের জন্য শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এছাড়া হাইড্রোলিক হর্ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এতে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
প্রতিদিনই সড়কে বিশৃঙ্খলায় চালকসহ পথচারীদের নিয়ম না মানার বিষয়টি সামনে আসে। তাই এসব নিয়ন্ত্রণেও ট্রাফিক পুলিশদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। আইন প্রয়োগ করতে গিয়েও হয় তদবির নয়তো পড়েন চাকরি হারানোসহ বদলির হুমকিতে। এসবের মধ্যেও আবার কখনো শিকার হন দুর্ঘটনার। তারপরও জীবিকার তাগিদের পাশাপাশি জনজীবনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপকদের। তবে ঢাকার মতো ব্যস্ততম নগরীতে ট্রাফিকের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিমই খেতে হয়।
রাজধানীর হাইকোর্ট মোড়ে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পরিদর্শক মো. সাগর আনাম বলেন, একবার সরকারি গাড়ি উল্টো পথে আসায় সেটি থামানোয় আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। সড়কে আইনভঙ্গের জন্য ব্যবস্থা নিতে গিয়ে চাকরি চলে যাওয়ার হুমকিতে পড়ি। এমন ঘটনা অনেকের সঙ্গেই ঘটে।
তবে হুমকি-ধমকি দিলেও আইনভঙ্গকারীদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কোনো বাধা নেই জানিয়ে ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ও উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক মো. মুনিবুর রহমান বলেন, সাধারণত আমরা সবাইকে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখি। ট্রাফিক আইন না মেনেও অনেকে চায় তাদের ক্ষমতা দেখাতে। তবে আইনভঙ্গ করলে যা করণীয় তা করারই নির্দেশনা রয়েছে। এক্ষেত্রে খারাপ আচরণ বা আইনভঙ্গ করে চলে গেলেও পরবর্তী স্থানে (পয়েন্টে) ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
উন্নত বিশ্বে রাস্তায় যেসব ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য উন্নতমানের মাস্ক দেওয়া হয়। বাংলাদেশে তেমন ব্যবস্থা নেই। এখানে সাধারণ মাস্ক ব্যবহার করতে চাইলেও সেটি নিজ টাকায় কিনে নিতে হয়। যদিও করোনাকালে সরকারিভাবেই এটা দেওয়া হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের জন্য সব জায়গায় ট্রাফিক বক্স সুবিধাও নেই। কোনো কোনো বক্সে নেই শৌচাগার। সেসব জায়গায় দায়িত্বরতদের আশপাশের মার্কেট, মসজিদ কিংবা পাবলিক শৌচাগারই ব্যবহার করতে হয়। এতে নারী ট্রাফিক পুলিশদের চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আবার অধিকাংশ ট্রাফিক বক্স পুলিশের ব্যক্তিগত বা কোনো কোম্পানি বা সংস্থার সহযোগিতায় করা। এগুলো স্থাপনের জন্য আবার নিতে হয় সিটি করপোরেশনের অনুমতি। কোনোটার অনুমতি না থাকলে ভেঙে ফেলতে হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন চাঁনখারপুল মোড়ে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক পুলিশ জানান, একটি বেসরকারি কোম্পানি এ মোড়ে ট্রাফিক বক্স নির্মাণে সহায়তা করেছে। সিটি করপোরেশন যেসব জায়গায় ট্রাফিক বক্স দিয়েছে সেগুলোতে নেই কোনো শৌচাগার। আবার অনেক মোড়ে কোনো ট্রাফিক বক্সই নেই।
ট্রাফিক পুলিশের সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ও উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ট্রাফিক পুলিশ বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের ফলে ফুসফুস, চর্মরোগ ও শ্রবণশক্তিজনিত সমস্যায় ভোগেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সময়মতো খাওয়ার সুযোগও হয় না। আবার এটি অনেকটা শারীরিক পরিশ্রমেরও কাজ। ফলে অনেকে নানা ধরনের সমস্যায় পড়েন, বিশেষত একটু বয়স্ক ট্রাফিক পুলিশরা।
ট্রাফিক বিভাগের প্রধান বলেন, আগে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পরিসর এত বড় ছিল না। ফলে সমস্যাগুলো কাটাতে কিছু সময় লাগবে। এরই মধ্যে আমরা ট্রাফিক বক্সগুলো উন্নত করছি, যেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ট্রাফিক সদস্যরা একটু রিফ্রেশমেন্টের সুযোগ পান। এছাড়া অনেক মোড়ে এখনো ট্রাফিক বক্স নেই, সেসব স্থানেও ধীরে ধীরে সুবিধা বাড়ানো হবে।
সূত্র: জাগো নিউজ