শিরোনাম
২০০৩-০৪ সালের কথা। রাজধানীতে তখন সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার সন্ত্রাসী বাহিনীর তাণ্ডব। আধিপত্য ধরে রাখতে প্রতিদিনই চলছে গোলাগুলি, আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া। অপরদিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবা। সর্বনাশা মাদকের বিস্তারও শুরু হতে চলেছে দেশে। তেমনই এক সময় এলিট ফোর্স হিসেবে যাত্রা শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান— র্যাব। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে ভরসার নাম র্যাব। আর জঙ্গি, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কাছে আতঙ্কের নাম। শুরু থেকেই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন, মানবপাচার বন্ধ, মাদক নির্মূল, জলদস্যুদের আটক ও পুনর্বাসনে সক্রিয় এই বাহিনী।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জীবন বাজি রেখে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে সংস্থাটি।
২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ টানা ৩৩ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবি’র আমির শায়খ আব্দুর রহমানকে সিলেটের শাপলাবাগ থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। প্রতিষ্ঠার পর এটিই ছিল র্যাবের সবচেয়ে আলোচিত অভিযান, সবচেয়ে বড় সাফল্য।
র্যাবের হাতে একে একে গ্রেফতার হয় বিভিন্ন জঙ্গি শীর্ষ নেতা। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শীর্ষ পর্যায়ের যে ছয় জঙ্গি নেতাকে বিচার শেষে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়, তাদের প্রত্যেককেই গ্রেফতার করেছিল র্যাব।
মানবাধিকারকর্মীরা কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছেন শুরু থেকেই। র্যাবের পক্ষ থেকে বরাবরই বিষয়গুলো অস্বীকার করা হয়েছে। উল্টো মানবাধিকার সমুন্নত রাখতেই র্যাব কাজ করে আসছে বলে জানান সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এমনকি জঙ্গি ও মাদকবিরোধী অভিযানে প্রাণও হারিয়েছেন র্যাবের শীর্ষ থেকে সাধারণ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা।
মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাবের হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং এই সংস্থার বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে।
তবে র্যাব শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসী বা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে নিজেদের জান-মাল ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়েই অনেকে নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনার প্রতিটিতে নিরপেক্ষ তদন্ত হয়েছে। র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিপরীতে মানবাধিকার রক্ষার জন্যই কাজ করে আসছে। ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সিলেটে এক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ প্রাণ হারান।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকেই র্যাব তার ম্যান্ডেট অনুযায়ী সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে আসছে। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ দমন, মাদক নির্মূল, সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে র্যাব ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
শুধু অভিযানই নয়, র্যাব বিভিন্ন মানবিক কাজেও অংশ নিয়েছে। করোনাকালীন নানান কাজ ছাড়াও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় র্যাবের হেলিকপ্টার দিয়ে গুরুতর আহতদের ঢাকায় এনে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘অভিযানের পাশাপাশি র্যাব ১৭ জঙ্গিকে সুপথে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজও করেছে র্যাব। মাদক নির্মূলে এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চালিয়েছে।’
র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন নামে একটি কর্ম পরিকল্পনাও নিয়েছে র্যাব। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব এ পর্যন্ত আড়াই হাজারেরও বেশি দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে।
বিরামহীন অভিযান
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ যাত্রা শুরুর পর ১৪ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে এলিট এ সংস্থা। এরপর থেকেই চলছে বিরামহীন অভিযান। ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেএমবির সামারিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানি, ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বায়তুল মোকারম এলাকা থেকে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান নামের শীর্ষ জঙ্গি নেতা (২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত), একই বছরের ৩ মার্চ সিলেটে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে জেএমবির আমীর শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান এবং এর চার দিনের মাথায় ময়মনসিংহ থেকে আলোচিত জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেফতার করে র্যাব।
র্যাবের ওই কর্মকতা বলছেন, ২০০৯ সালে ভয়ানক জঙ্গি মিজানুর রহমান ওরফে বোমা মিজানকে (২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে পালিয়ে যায়, বর্তমানে ভারতীয় কারাগারে বন্দি) তার মিরপুরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। বোমা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে জেএমবিতে খ্যাত ছিল মিজান। ২০১৬ সালের আলোচিত গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পরও আরও অনেক শীর্ষ জঙ্গি নেতাকে গ্রেফতারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে র্যাব।
র্যাবের ধারাবাহিক অভিযানে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের একাধিক শীর্ষ নেতা, সুরা ও শরিয়া বোর্ড সদস্য, মহিলা শাখা ও তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞকে গ্রেফতার হয়। যার কারণে হোলি আর্টিজানের মতো আরও একাধিক জঙ্গি হামলার ঘটনা অঙ্কুরেই নস্যাৎ হয়ে যায়।
র্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, হোলি আর্টিজানের পর র্যাবের হাতে দেড় হাজারেরও বেশি জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় এক হাজার সদস্য ছিল জেএমবি’র।
মাদক ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি, চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারসহ অনেক অপরাধের নেপথ্যে আছে মাদক। এ কারণে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে কাজ করছে র্যাব।
২০১৮ সালের ৩ মে র্যাবের ১৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স জোরদারসহ আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান ধারণ করে দেশজুড়ে ব্যাপক অভিযান শুরু করে র্যাব।
র্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের ৩ মে’র পর থেকে প্রায় ৫৫ হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে তারা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রেফতার করেছে প্রায় দেড় লাখ মাদক কারবারিকে। জব্দ করেছে তিন হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের মাদক।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাড়ে ছয় কোটিরও বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া প্রায় আট শ’ কেজি হেরোইন, ৩৭ লাখেরও বেশি ফেনসিডিল জব্দ করেছে।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে এখন মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি। মিয়ানমার থেকে সমুদ্রপথেই এগুলো দেশে আসছে। এ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের গহীন এলাকা দিয়েও ইয়াবা ঢুকছে প্রতিনিয়ত। ইয়াবা প্রবেশের রুটগুলো বন্ধ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করছে র্যাব। একই সঙ্গে কক্সবাজারসহ আশেপাশের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকা করে নিয়মিত অভিযানও চালাচ্ছে।
‘ট্র্যাডিশনাল ক্রাইম’ প্রতিরোধেও সফল
জঙ্গি-সন্ত্রাসী দমনের পাশাপাশি ট্র্যাডিশনাল তথা প্রথাগত অপরাধ দমনেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে এলিট ফোর্স র্যাব। রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের শক্ত হাতে দমন করেছে সংস্থাটি। সেই ধারাবাহিকতা এখনও বজায় রেখেছে তারা।
র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, মানবপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে এখন পর্যন্ত ১২শ’র বেশি অপরাধীকে গ্রেফতার ও এক হাজারের বেশি ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে র্যাব। এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও আড়াই লাখেরও বেশি গোলাবারুদ্ধ জব্দ করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনকেন্দ্রীক পাঁচ শতাধিক জলদস্যু ও বনদস্যুকে গ্রেফতার করার পাশাপাশি প্রায় দুই হাজার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাবের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিশেষ অভিযানের পাশাপাশি ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন ও পলাতক আসামিদের ধরতেও র্যাব নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে। এ ছাড়া ভেজালবিরোধী প্রায় ১০ হাজার অভিযান চালিয়ে আড়াই শ’ কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
র্যাব এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ
র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করা র্যাব এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্থা। দিনে দিনে ব্যাটালিয়ান যেমন বেড়েছে, তেমনি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও যোগ হয়েছে। এখন দেশি-বিদেশি যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসীকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে র্যাব।
ইদানিং বেড়েছে সাইবার ক্রাইম। র্যাবও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শনাক্ত করছে সাইবার অপরাধীদের। নিজস্ব হেলিকপ্টারে দুর্গম এলাকায় দ্রুত দেশের যেকোনও স্থানে অভিযান পরিচালনা করতে পারছে তারা। আছে চৌকস ডগ স্কোয়াড ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটও।
র্যাবের রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানের ফরেনসিক ল্যাব। আছে ক্রাইম ডাটা সেন্টার। যে কোনও অপরাধী গ্রেফতার হলেই তার পিসিপিআর (প্রিভিয়াস ক্রাইম অ্যান্ড পারসোনাল রেকর্ড) জানা যায় মুহূর্তেই।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সাইবার, ট্র্যাডিশনাল অপরাধ থেকে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদসহ আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনেও র্যাব পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।’