শিরোনাম
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ দিন। এদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছিল যে সংবাদ তাহলো—বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার মাত্র ৬ জন সদস্য ছাড়া প্রায় সব সদস্য খুনি খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন। ইতিহাস গবেষকরা বলছেন, ওই সময় যারা খুনি সরকারের পক্ষে থাকতে রাজি হননি, তাদের পরিণতি হয়েছিল চার নেতার মতো। মৃত্যুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা পেতেই মন্ত্রিসভার অংশ হয়েছিলেন বেশিরভাগ। তবে এরমধ্যে মতাদর্শগত বিভ্রান্তিও কারও কারও মধ্যে ছিল বলেও মত তাদের।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সর্বশেষ মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি। ওই মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন ক্যাপ্টেন মো. মনসুর আলী।
৩০ সদস্যের ওই মন্ত্রিসভার অন্য মন্ত্রীরা ছিলেন—খন্দকার মোশতাক আহমেদ (বাণিজ্যমন্ত্রী), এএইচএম কামরুজ্জামান (শিল্পমন্ত্রী), মোহাম্মদ উল্লাহ (ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কারমন্ত্রী), আব্দুস সামাদ আজাদ (কৃষিমন্ত্রী), অধ্যাপক ইউসুফ আলী (শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী), শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার (এলজিআরডিমন্ত্রী), ড. কামাল হোসেন (পররাষ্ট্রমন্ত্রী), মো. সোহরাব হোসেন (পূর্ত ও গৃহনির্মাণমন্ত্রী), আব্দুল মান্নান (স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী), আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (মৎস্য, বন, বন্যা এবং বিদ্যুৎশক্তিমন্ত্রী), শ্রী মনোরঞ্জন ধর (আইন, বিচার, সংসদ বিষয়কমন্ত্রী), অ্যাডভোকেট আব্দুল মোমিন (খাদ্য ও পুনর্বাসনমন্ত্রী), আসাদুজ্জামান খান (পাটমন্ত্রী), এম কোরবান আলী (তথ্য ও বেতারমন্ত্রী), ড. আজিজুর রহমান মল্লিক (অর্থমন্ত্রী), ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী (শিক্ষা, আণবিক শক্তিমন্ত্রী), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (বন্দর ও জাহাজ দফতরমন্ত্রী), নুরুল ইসলাম মঞ্জুর (প্রতিমন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়), আব্দুল মোমিন তালুকদার (প্রতিমন্ত্রী, এলজিআরডি), দেওয়ান ফরিদ গাজী (প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য, পাট ও চা),অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী (প্রতিমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়), তাহের উদ্দিন ঠাকুর (প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও বেতার), মোসলেম উদ্দিন খান (প্রতিমন্ত্রী, পাট মন্ত্রণালয়), কে এম ওবায়দুর রহমান (প্রতিমন্ত্রী, ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ), ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল (প্রতিমন্ত্রী, সাহায্য ও পুনর্বাসন), রিয়াজ উদ্দিন আহমদ (প্রতিমন্ত্রী, বন, মৎস্য ও পশুপালন) ও সৈয়দ আলতাফ হোসেন (প্রতিমন্ত্রী)।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের দিনের মন্ত্রিসভা
৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের রাষ্ট্রপতি হন খুনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ, উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। মোশতাকের অধীনে যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছিল তার সদস্য ছিলেন—অধ্যাপক ইউসুফ আলী (মন্ত্রী, পরিকল্পনা দফতর), শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার (মন্ত্রী, এলজিআরডি), মো. সোহরাব হোসেন (মন্ত্রী, পূর্ত, গৃহনির্মাণ), আব্দুল মান্নান (স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী), শ্রী মনোরঞ্জন ধর (আইন, বিচার, সংসদমন্ত্রী), আব্দুল মোমিন তালুকদার (মন্ত্রী, কৃষি দফতর ও খাদ্য), আসাদুজ্জামান খান (মন্ত্রী, বন্দর ও জাহাজ চলাচল), ড. আজিজুর রহমান মল্লিক (অর্থমন্ত্রী), ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী (শিক্ষামন্ত্রী), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (মন্ত্রী, পররাষ্ট্র দফতর), শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (প্রতিমন্ত্রী, বিমান ও পর্যটন), তাহের উদ্দিন ঠাকুর (প্রতিমন্ত্রী, তথ্য, বেতার, শ্রম), কে এম ওবায়দুর রহমান (প্রতিমন্ত্রী, ডাক ও তার), নুরুল ইসলাম মঞ্জুর (প্রতিমন্ত্রী, রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়), দেওয়ান ফরিদ গাজী (প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য, খনিজসম্পদ), অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী (প্রতিমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়), রিয়াজ উদ্দিন আহমদ (প্রতিমন্ত্রী, বন, মৎস্য ও পশুপালন), মোসলেম উদ্দিন খান (প্রতিমন্ত্রী, পাট মন্ত্রণালয়), মোমেন উদ্দিন আহমেদ (প্রতিমন্ত্রী, বন্যা, পানি বিদ্যুৎ), ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল (প্রতিমন্ত্রী, সাহায্য ও পুনর্বাসন), সৈয়দ আলতাফ হোসেন (প্রতিমন্ত্রী, সড়ক যোগাযোগ)।
কেন এই মানুষগুলো সেদিন না করতে পারলেন না। পরের দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত শপথ অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখা যায়—যখন শপথ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন বঙ্গভবনের বাইরে ট্যাংক মোতায়েন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, তাই তারা বন্দুকের নলের সামনে বাধ্য হয়েছিলেন ওই মন্ত্রিসভায় যোগদান করতে। এর বাইরে সেই সময় তাদের আর কোনও উপায় ছিল না। যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন, তারা প্রত্যেকে কোনও না কোনোভাবে ভুগেছেন।’
মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে যে আদর্শিক চেতনা থাকা দরকার, সেই আদর্শিক চেতনা তাদের কারও ছিল বলে মনে করেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তেমনটা সবার ক্ষেত্রে মনে হয় না। তবে এদের মধ্যে এক- দুইজন ছিলেন—যারা সেই কারণ থেকে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাকিরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, করণীয় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে।’
১৫ আগস্টের আগে ও পরের দুটি মন্ত্রিসভার তালিকার তুলনা করলে দেখা যায়, মাত্র ৭ জন খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় অনুপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে যারা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেননি, তাদের মধ্যে—সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপ-রাষ্ট্রপতি), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (প্রধানমন্ত্রী), এএইচএম কামরুজ্জামান (শিল্পমন্ত্রী) ৩ নভেম্বর মোশতাকের নির্দেশে কারাগারে নির্মমভাবে শহীদ হন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় মন্ত্রিসভায় ছিলেন না তাজউদ্দীন আহমদ। তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরপরই আব্দুস সামাদ আজাদকে (কৃষিমন্ত্রী) গ্রেফতার করা হয়েছিল। এছাড়া বাকিরা সবাই কীভাবে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন, সেটা একটি বড় প্রশ্ন।
ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল বিধায় খুশি হয়ে কেউ মন্ত্রিসভায় রয়ে গেছেন বা যুক্ত হয়েছিলেন কিনা প্রশ্নে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘তারা এক নম্বরের ভীতু ছিল। তারা আদর্শচ্যুত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্রের কারণে। এদেরই কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর হত্যা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল।’ তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জুরদের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে এদের কোনও না কোনও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এজন্যে তারা মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন।’