আঁখির হাসপাতালে ভর্তির ‘তথ্য জানতেন’ ডা. সংযুক্তা সাহা

ফানাম নিউজ
  ২২ জুন ২০২৩, ০৩:৫৬
আপডেট  : ২২ জুন ২০২৩, ০৪:০১

‘ভুল চিকিৎসায়’ ইডেন কলেজের প্রয়াত শিক্ষার্থী মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা জট। ইয়াকুব আলী সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে তার স্ত্রী আঁখিকে ভর্তি করালেও ওই চিকিৎসকের দাবি— তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। কারণ, তিনি তখন দেশের বাইরে ছিলেন। তবে বিদেশে অবস্থান করলেও মামলার প্রাথমিক তদন্তে হাসপাতালের সঙ্গে ডা. সংযুক্তা সাহার যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। এ বিষয়ে যেকোনও সময় ডা. সংযুক্তা সাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে পুলিশ। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত দুই চিকিৎসক আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হাসপাতালে রোগীর (আঁখি) ভর্তি হওয়ার তথ্য সংযুক্তা সাহার অবহিত থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন। গত ১৫ জুন মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহ দিবা ছন্দার আদালতে চিকিৎসক মুনা সাহা ও শাহজাদী মুসতারশিদা সুলতানার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

মামলার তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে গত বুধবার (১৪ জুন) রাতে ধানমন্ডি থানায় পাঁচ জনকে আসামি করে মামলা করেন আঁখির ইয়াকুব আলী সুমন। সেদিন রাতেই ডা. শাহজাদী মুসতারশিদা সুলতানা এবং ডা. মুনা সাহাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন। মামলায় বাকি তিন আসামি ‘গা ঢাকা’ দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে ডা. মিলিকে খোঁজা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ।

পুলিশের সূত্র আরও জানায়, ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনাকে দুগ্রেফতারের পর প্রাথমিকভাবে তারা দোষ স্বীকার করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তাদের তারা জানিয়েছেন, মাহবুবা রহমান আঁখির ভর্তির তথ্য ডা. সংযুক্তা সাহাকে তারা জানিয়েছিলেন।

তদন্ত সূত্রে আরও জানা যায়, ঘটনার রাতে এই দুই চিকিৎসক আঁখির অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু অপারেশনের পর জটিলতা দেখা দেওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানান তারা। তখন গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মাকসুদা ফরিদা আকতার মিলি অপারেশন থিয়েটারে ঢোকেন।

মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, ‘তদন্তের প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেন্ট্রাল হাসপাতালের যে কাউকে ডাকা হতে পারে।’

জানা যায়, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ডা. শাহজাদী জানান, রোগী ভর্তি হওয়ার এক ঘণ্টা আগে সংযুক্তা সাহা তাকে কল করেছিলেন। তিনি কুমিল্লার রোগী এলে দেখার নির্দেশ দিয়ে কল কেটে দিয়েছিলেন।

ডা. শাহজাদী সুলতানা জবানবন্দিতে আরও বলেন, ‘‘রাত ১১টায় (৯ জুন) ম্যাডাম (ডা. সংযুক্তা সাহা) আমাকে ফোন করে কুমিল্লার রোগী এসেছে কিনা জানতে চান। আমি ‘না’ বললে তিনি বলেন, ‘রোগী এলে যেন আমি দেখি।’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন। রাত সাড়ে ১২টায় ডা. মুনা সাহা ফোন করে কুমিল্লা থেকে রোগী আসার কথা আমাকে জানান। রাত একটায় আমি হাসপাতালে উপস্থিত হই।’’

ডা. শাহজাদী বলেন, ‘রোগীর স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করা হয়। আমি রোগীকে দুটি ইনজেকশন দিই। কিন্তু বাচ্চার হার্টবিট আপ-ডাউন দেখে— আমি অধ্যাপক সামিনা ম্যাডামকে তিন বার ফোন দিই। কিন্তু তিনি একবারও ফোন ধরেননি। এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীর জরায়ুর সাইড কেটে দেওয়া হয়। এক দশমিক পাঁচ ইঞ্চি সাইড কাটা হয়। এরপর রোগীকে সন্তান প্রসবের জন্য চাপ দিতে বলা হয়। কিন্তু রোগী বলেন, তিনি আর পারছেন না এবং তার খারাপ লাগছে। রোগীকে দ্রুত অপারেশন টেবিলে নেওয়া হয়। তখন ডা. জামিল ও ডা. আলম দুজনে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা সিপিআর দিতে থাকেন। তখনও ডা. মিলি এসে পৌঁছাননি। ডা. জামিল ও ডা. আলম আমাকে বাচ্চা বের করে দিতে বলেন। এরপর জরায়ু সেলাই করা হয়। এ সময় জরায়ু নরম ছিল এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এ অবস্থায় রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হয়।’

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ডা. মুনা সাহা জানান, ৯ জুন রাত ১০টা ২০ মিনিটে আমি ডিউটি শুরু করি। হাসপাতালে এসে ডা. শাহজাদীকে বসে থাকতে দেখি। এ সময় ডা. শাহজাদী জানান, কুমিল্লা থেকে ডা. সংযুক্তা সাহার রোগী আসার কথা রয়েছে। তাই তিনি বসে আছেন। কিছু সময় পর তিনি (শাহজাদী) হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান এবং বলেন, রোগী এলে যেন তাকে জানানো হয়। রাত ১২টা ২৫ মিনিটে রোগী মাহবুবা রহমান আঁখি অনেক ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন।

ডা. মিলি বলেন, ‘রোগী আঁখি তাকে জানান, কুমিল্লা থেকে আসার আগে ম্যাডামের (ডা. সংযুক্তা সাহা) সঙ্গে তিনি কথা বলে এসেছেন। ফলে সংযুক্তা সাহা উপস্থিত না থাকার পরও তার নামেই রোগী ভর্তি করা হয়।’

এদিকে ডা. সংযুক্তা সাহার দাবি করেন, আঁখির ভর্তি হওয়ার বিষয়ে তাকে কিছুই জানানো হয়নি। মঙ্গলবার (২০ জুন) নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন তিনি।

ডা. সংযুক্তা সাহা বলেন, ‘প্রয়াত আঁখিকে ৯ জুন রাতে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আমার অধীনে ভর্তির বিষয়ে কোনও মৌখিক বা লিখিত অনুমতি গ্রহণ করেনি। এ সময় আমার উপস্থিতির বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিথ্যা তথ্য দিয়েছে যে, আমি বাংলাদেশে আছি।’

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার আগ পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আমি ছিলাম গর্ব। আর নিজেদের গাফিলতি লুকানোর জন্য আমার নামে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়াচ্ছে। বিশ্বাস করেন, সেন্ট্রাল হসপিটাল আমার নাম ব্যবহার করে অনিয়ম করেছে। তারা এমন অনিয়ম করবে, আমি ভাবতেও পারিনি।’

এদিকে ডা. সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা সংক্রান্ত লাইসেন্স বাতিল করে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন তার সহপাঠীরা। বুধবার (২১ জুন) দুপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে এক স্মারকলিপি দিয়ে এই দাবি জানান তারা।

অপরদিকে গ্রেফতারকৃত ডা. মুনা সাহার মুক্তির দাবি উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক পোস্টে বলা হয়— ‘ডিউটি ডাক্তার কারাগারে কেন’, ডা. মুনার নিঃশর্ত মুক্তি চাই’। এই চিকিৎসকদের দাবি, ‘যেহেতু তিনি (ডা. মুনা) কর্তব্যরত চিকিৎসক, হাসপাতালে ওই সময়ে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার তিনি সাক্ষী এবং কর্তব্যরত একজন। রোগী রিসিভ, বিদায়, টুকটাক সেলাই। ওটি হলে অ্যাসিস্ট করা— তিনি সব করেন। এখন রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি ডাক্তার তার ডিউটিতে। কাছাকাছি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত কেউ ওই হাসপাতালে ভর্তি হলো। ডিউটি ডাক্তার তাকে রিসিভ করলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হয়তো রোগী মারা গেলো। রোগীর হয়তো ব্রেনে রক্তক্ষরণ বা খারাপ কিছু দুর্ঘটনায় ঘটেছে। হাসপাতালে আনতেই শেষ। এখন এই মৃতের স্বজন যদি মামলা করেন— আর ক্রাইম না করা কর্তব্যরত চিকিৎসককে যদি জেল হাজতে নিয়ে তার পুরো জীবন, ক্যারিয়ার, সংসার,পরিবার সব শেষ করে দেওয়া হয়।এ কেমন ডাক্তারি? এ কেমন নিয়ম!’

সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ২১ জুন প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা পিছিয়েছে। তদন্ত বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকেও বাতিল করেছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা জানায়, তদন্ত কমিটি আরও সাত দিন সময় চেয়েছে। তবে তাদের চার দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।