শিরোনাম
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, এমন ছোট বড় অনেক কিছুই এখন অতীতের ইতিহাস। যার সঙ্গে বর্তমানের আর কোনও যোগ নেই। একদিকে যেমন গ্লোবালাইজেশনের ভেতর দিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের মনোজগতের ও অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনি ইউক্রেন যুদ্ধ কোভিড-উত্তর পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছে।
এ সময়ে ভারত শুধু দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় দেশ নয়, পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ লোকের বাস যে দেশটিতে এবং সবকিছুর পরেও যার অর্থনীতি, সমরশক্তি ও অর্থনৈতিক বাজার অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই; এমন একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি যেমন তাদের নিজের ইচ্ছেতে তেমনি পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে ও বাস্তবতার সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর গত মাসের শেষ সপ্তাহে দিল্লিতে তাঁর ইউরোপীয় কাউন্টারপার্টদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের জন্যে একটা ‘ওয়েকআপ কল। এবং এশিয়ার জন্যেও একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ, এশিয়াকেও নিয়মভিত্তিক পথে এগোতে হবে’। তাঁর ওই কথার লাইন বিটুইন সত্য হলো, সেই নিয়মভিত্তিক পথে এশিয়াতে ইউরোপ এবং আমেরিকাকেও সঠিক কাজটি করতে হবে। কোনোরূপ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলে চলবে না। এখানে বেশ জোরের সঙ্গে জয়শঙ্কর আফগানিস্তান প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি বলেছেন, প্রায় এক বছর হতে চললো সেখানে কোনও প্রকৃত সরকার নেই। দেশের সিভিল সোসাইটিকে দেশ থেকে দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তার ভাষায় ‘বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে’।
বাস্তবে ইউরোপের জন্যে এ মুহূর্তে সব থেকে বড় সমস্যা যেমন ইউক্রেন, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে সব থেকে বড় সমস্যা আফগানিস্তান। একটা দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং চিন্তাশীল সিভিল সোসাইটিকে যখন রাষ্ট্র থেকে বাদ দেওয়া হয়, তখন বাস্তবে ওই দেশটি আর দেশ থাকে না। তার ওপরে আফগানিস্তান দখল করে আছে বিশ্বস্বীকৃত সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ তালেবানরা। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই বিষফোঁড়াটি নিয়ে সত্যি অর্থে ইউরোপ ও আমেরিকা কারোরই ওই মাপের মাথাব্যথা নেই। অথচ এ পরিস্থিতির জন্যে তারাই অনেকখানি দায়ী। আফগানিস্তানের চিন্তাশীল সিভিল সোসাইটির একজন প্রতিনিধি শ্যামে পানাহ্– যিনি আফগানিস্তানের এই তালেবান দ্বারা উৎখাত হয়ে যাওয়া সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থিত আফগানিস্তানের এই থিঙ্ক ট্যাংক বলেন, আমেরিকা আফগানিস্তান নিয়ে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার ফলে আফগানিস্তানে এখন এই ভয়াবহ অবস্থা। এবং প্রায় ৯ মাস সরকার ছাড়া একটা দেশ চলছে। শ্যামে পানাহর কথার সুরের সঙ্গে জয়শঙ্করের কথার সুরের মিল আছে। আর বাস্তবে আফগানিস্তানে একটি প্রকৃত সরকার, যার সঙ্গে সমাজের শিক্ষিত, আধুনিক মধ্যবিত্তসহ চিন্তাশীল সিভিল সোসাইটির যোগ থাকবে– এটা প্রতিষ্ঠা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠা শুধু নয়, বিশ্ব সন্ত্রাসমুক্ত হতে পারবে না। তাই পশ্চিমা বিশ্বকে শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এগোলে হবে না, তাকে আফগানিস্তানে প্রকৃত সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। অতীতেও যেমন ভারতের সহযোগিতায় তারা এ কাজ করেছে এখন তাদের জন্যে একমাত্র সেই পথই খোলা আছে।
এই কলামে আগেও লিখেছি, ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। এখন বিষয়টি আরও পরিষ্কার এ যুদ্ধ অনেক বেশি সময় ধরে চলতে পারে। কারণ, ইউরোপীয় দেশগুলো, বিশেষ করে তাদের বড় শক্তি জার্মানি বলছে, তারা এ বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করবে। বাস্তবে ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো যে পরোক্ষ যুদ্ধে জড়িয়েছে পাশাপাশি যে অর্থনৈতিক অবরোধ চলছে তা আরও কঠোর করে এই যুদ্ধের শেষ হতে কয়েক বছর লেগে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এ অবস্থায় ভারত যে সময়টা পাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তারাও ধীরে ধীরে রাশিয়া থেকে সরে আসার পথ তৈরি করছে। প্রথমত, বর্তমান ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার যে সম্পর্ক এই সম্পর্ককে কোনও মতেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের সঙ্গে মেলানো চলে না। এ অনেক ক্ষীণ সম্পর্ক। তারপরেও ভারত যে পররাষ্ট্রনীতি এখানে গ্রহণ করেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, তারা তাদের মতো করে রাশিয়ার থেকে বের হয়ে আসবে। আর এর সব থেকে বড় কারণ, এ মুহূর্তে ভারতের জন্যে সব থেকে বড় হুমকি চীন। এই চীনই এখন রাশিয়ার বন্ধু। তাই চীনের কারণেই ভারতকে তার নিজের জন্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, শুধু ভারত নয়, চীনের বিপরীতের সব শক্তিই এখন ধীরে ধীরে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের মধ্যের শক্তিকে দৃঢ় করছে। যদিও তা দ্রুত সম্ভব নয়। এর জন্যে সময় নেবে সবগুলো দেশ। যেমন, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার ভেতরে এখান থেকে কয়েক বছর আগেও বাণিজ্য যে হারে বাড়ছিলো– অস্ট্রেলিয়া তা কমিয়ে দিয়েছে। এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট হিসেবে ভারতের সঙ্গে তারা ব্যাক টু ব্যাক বাণিজ্য চুক্তি করেছে। ওই বাণিজ্য চুক্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া বিনা শুল্কে ভারতকে তাদের দেশে অনেক বেশি পণ্য ঢোকার সুযোগ দিয়েছে। বরং অস্ট্রেলীয় পণ্য বেশিরভাগ শুল্ক দিয়েই ভারতে ঢুকবে। এছাড়াও ভারতীয় ছাত্ররা সেখানে সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে ওয়ার্কিং ভিসা পাবে। যার ফলে তারা বৈধভাবে আয় করতে পারবে।
এর পাশাপাশি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে কাজ করার জন্যে আরও শক্তিশালী ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়েছে। এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানো নিয়ে আগে থেকেই কাজ চলছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের পরে ধারণা করা যাচ্ছে দুই দেশের বাণিজ্য নিয়ে তৈরি এ কমিটি আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে ব্রিটিশ ও ভারতের মধ্যে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারবে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধানের গত মাসে দিল্লি সফরের সময় যে আলোচনা হয়েছে, তাতেও স্পষ্ট- ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্য করে তার কতটা অংশ তারা ভারতে নিয়ে আসতে পারবে তা নিয়ে চিন্তা করছে।
আর এর পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি ইউরোপীয় তিন গুরুত্বপূর্ণ দেশ- জার্মানি, ফ্রান্স ও ডেনমার্ক সফর করেছেন। এই তিন দেশেই নরেদ্র মোদির বিপরীত দিকের সমপক্ষ তাঁকে ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেছেন। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের পক্ষে নিজের অবস্থানকে মোটেই নেননি। তবে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটানো যায় কিনা তারই আহ্বান জানিয়েছেন। শ্রী মোদির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও একই কথা বলছেন। জয়শঙ্করের কথার ভেতর ১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জার যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের দূতিয়ালি করে সমাধানে নিয়ে গিয়েছিলেন তেমন একটা ধ্বনি আছে। জয়শঙ্কর অনেক বড় কূটনীতিক। তিনি অন্যান্য কয়েকটি ভাষার সঙ্গে রুশ ভাষাও ভালো জানেন। তাছাড়া বিবাহসূত্রে জাপানের সঙ্গে তার বাড়তি সম্পর্ক। তাই আমেরিকা, সেন্ট্রাল এশিয়া , এশীয় শক্তি জাপান এবং সর্বোপরি ইউরোপের সহায়তা নিয়ে জয়শঙ্কর কি হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকায় নামতে পারবেন? খুব আশা এখানে দেখা যায় না। কারণ, ১৯৭৩-এ আমেরিকা অনেক বড় একক শক্তি ছিল সবদিক থেকে। এখন আমেরিকা সেই শক্তি নেই। তাছাড়া কিসিঞ্জার যাদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তারা অনেক বড় মাপের নেতা। তার বিপরীতে এখন ইউক্রেন পরিস্থিতি ভিন্ন। ইউক্রেনের প্রতিপক্ষ রাশিয়ার নেতা পুতিন মোটেই কিসিঞ্জারের আমলের মধ্যপ্রাচ্যের মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, এমনকি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের মতো নেতা নন। পুতিন মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম বা হিটলারের মতো নেতা। এমনকি অনেকে পুতিন, কিম ও হিটলারের সঙ্গে একই লাইনে চীনের জি পিংকে রাখেন। বাস্তবে জি পিংকে ওই লাইনে রাখলেও ভুল হবে। জি পিং অটোক্রাট হলেও পুতিন, হিটলার বা কিমের মতো স্বেচ্ছাচারী ডিক্টেটর নন। তাই পুতিন বা হিটলারদের মতো স্বেচ্ছাচারী ডিক্টেটরদের সঙ্গে আলোচনায় বসে শেষ অবধি কোনও লাভ হয় না। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। বামপন্থী এটলি বুঝতে পারেননি। কারণ, ডিক্টেটর বা স্বৈরাচাররা সবসময়ই দুই ধরনের কাজ ও কথা একসঙ্গে উপস্থিত করে। স্বাভাবিক মানুষ বা উদারপন্থী মানুষ তার মানসিক গঠনের কারণেই যুক্তিযুক্ত অংশটুকুই বিশ্বাস করে, তার ওপর ভিত্তি করে আলোচনা করতে চায়। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু স্বৈরাচারের মানসিক গঠনই হলো শেষ অবধি অযৌক্তিক কাজ করা। তাই ভারত যতই আলাপ-আলোচনার কথা বলুক না কেন, তাদের মাথায় রাখতে হবে, পুতিন কোনও স্বাভাবিক রাষ্ট্রপ্রধান নন। তিনি একজন স্বৈরচার। তিনি যে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে এসেছেন সে নির্বাচন হিটলারের নির্বাচনের থেকেও অনেক খারাপ নির্বাচন। এ ধরনের খারাপ নির্বাচন বা অবৈধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভালো মানুষও নির্বাচিত হলে তারও মানসিক গঠন বদলে যায়। তিনিও শেষাবধি অদ্ভুত আচরণের স্বৈরাচার হয়ে যান। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে শেষাবধি স্বৈরাচারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় লাভ হওয়ার ঘটনা বিরল।
ভারত তাই যেমন অর্থনৈতিক দিগন্ত বদলানোর জন্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে মনোযোগী হয়েছে, মনোযোগী হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার দিকে, তেমনি ট্রাম্পের আমলে তারা আশিয়ান থেকে দূরে সরে গেলেও এখন আবার বাইডেনের সঙ্গে ভারতও আশিয়ানের পাশে আসবে। পাশাপাশি মোদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন সফরের সময় দাওয়াত পেয়েছেন জি-৭ এর। তবে এই অর্থনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি ভারত সরে আসছে তাদের সামরিক সরঞ্জাম ও সামরিক অস্ত্রের ফর্মুলার বিষয়ে। একটা সময়ে ঐতিহাসিক কারণে ভারত অনেক বেশি সামরিক সরঞ্জামের বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্ভর হয়ে পড়েছিল। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়া ও ভারতের উদারীকরণ নীতি গ্রহণের পর থেকে তাদের এ বিষয়ে সোভিয়েত থেকে সরে আসা শুরু হয়। মোদির আমলে ইতোমধ্যে ভারতে আমেরিকান সামরিক বিমান তৈরির প্ল্যান্ট নিয়ে চুক্তি হয়েছে। এখন মোদির এই ইউরোপীয় সফরে দেখা গেলো তারা আরও ইউরোপীয় অস্ত্রের দিকে ঝুঁকছে। ইতোমধ্যে ভারতীয়দের তরফ থেকে ৭টি অত্যাধুনিক সাবমেরিনের বিষয়ে ফ্রান্সকে বলা হয়েছে বলে মিডিয়ায় খবর এসেছে। জার্মান থেকেও যে তারা সামরিক সরঞ্জাম কিনবে তাও দুই দেশের আলোচনার সুর থেকে অনেকখানি বোঝা যায়।
বাস্তবে চীনের ডোকলাম আক্রমণের পরে ভারতের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ভাবার বিষয়টি সামনে এসেছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ভারত এ মুহূর্তে আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক কাছে আসাতে তাদের সামরিক সরঞ্জাম আধুনিককরণের জন্যে স্থান পরিবর্তনটা আরও সহজ হয়েছে। মূলত, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধই ভারতকে প্রথম আত্মোপলব্ধি করতে সাহায্য করে তাদের আধুনিক সমরাস্ত্র দরকার। তারপরে ১৯৬৫’র পাকিস্তান- ভারত যুদ্ধে তারা আধুনিক সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও যুদ্ধ শেষে তারা বুঝতে পারে যুদ্ধের জন্যে, দেশের জন্যে শক্তিশালী গোয়েন্দা যুদ্ধ অনেক বেশি দরকার। ভারত সে পথে পা বাড়ায়। যা তাদের ১৯৭১-এ সাফল্য এনে দেয়। তারপরেও আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব’র অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র থেকে অনেকখানি পিছিয়ে ভারত। ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতকে অতীতের ইতিহাস থেকে টেনে বের করে এনে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের সঙ্গেই যোগ করে দিচ্ছে। আর সেই পথেই এগোচ্ছে তাদের পররাষ্ট্রনীতি।
কিন্তু সমরশক্তির থেকে বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তিই যে বড় তা অনেকখানি স্পষ্ট হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধের এই অর্থনৈতিক অবরোধের যুদ্ধ। তাই ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে সব ইতিহাস নির্ভরতা ছেড়ে অর্থনৈতিক দিকটাতে গুরুত্ব দিয়েছে, তার একটি বড় প্রমাণ তাদের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কটরার নিয়োগ। বিনয় মোহন কটরা ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট এবং তার ক্যারিয়ারের বড় অংশজুড়ে বাণিজ্য ও অর্থনীতি। তাই তাঁর এই নিয়োগে স্পষ্ট করে দেয় এ মুহূর্তে তাদের কূটনীতিতে অর্থনীতিকে জোর দেওয়া হবে বলেই মি. কটরাকে এখানে নিয়ে আসা। আর তিনি যে সময়টাতে এসেছেন সে সময়ে মোদির ‘প্রতিবেশী আগে’ নীতিতে দুই প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও নেপাল অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। এই দুই দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনার দায় এখন ভারতের ওপর। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক বিশ্ব ফোরামগুলোর সাহায্য নিয়ে এ দুই দেশকে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে তুলতে ভারতকেই এগিয়ে যেতে হবে। শ্রীলঙ্কাতে ইতোমধ্যে ভারত এগিয়ে গিয়েছে। এবং তারা সেখানে দ্রুতই কাজ করছে। ইউরোপীয় দেশ, আমেরিকা ও জাপানকে সংযুক্ত করে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি রক্ষায় বড় ভূমিকা এ মুহূর্তে ভারতকে রাখতে হবে। চীনকে ক্রমেই এখান থেকে দূরে সরানোর পথেই ভারত এগোবে। তেমনি চীন অনেক বেশি নেপালে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ঢুকে গিয়েছিলো- সেখান থেকে নেপালকে বের করে আনার ক্ষেত্রে নেপালের তৎকালীন হাইকমিশনার হিসেবে বিনয় মোহন কটরা, তাদের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার যোগ্য সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। এখন নেপাল ভারতের অনেক কাছাকাছি। তারপরেও দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে চীন তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের হাত বাড়াচ্ছে। বিনয় মোহন কটরাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সহযোগী হিসেবে তাঁর নেপালের অভিজ্ঞতাকে কাজ লাগাবে ভারত তাও অনেকটা পরিষ্কার। অন্যদিকে, নেপালের একজন মন্ত্রীর বক্তব্য হলো, চীন সীমান্তে নেপালের জনবসতিও কম। তাছাড়া বাণিজ্য ও চলাচল সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে ভারতই তাদের ভালো সহযোগিতা দিতে পারে। তারা আশা করছে, ১৬ মে নরেন্দ্র মোদির নেপাল সফর সেদিক থেকে একটা মাইলফলক হবে। বাস্তবে শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান ভারতকে আরও গুরুত্ব দিয়ে করতে হচ্ছে এ কারণে, এ দুই দেশে বেশি সংকট হলে ভারতকে শরণার্থীর চাপে ভুগতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় এ মুহূর্তে সব থেকে সংকটে আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব আফগানিস্তানসহ আফগানিস্তানের দুপাশেই কাজ করে এসেছেন। সফল হয়েছেন নেপালের হাইকমিশনার হিসেবে। তাই জয়শঙ্করের যোগ্য সহযোগী হিসেবেই তাঁর নিয়োগ সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। আর শ্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে বিনয় মোহন কটরা অবধি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাচ্ছে, তারা অতীতের ইতিহাস ঝেড়ে ফেলে নতুন পররাষ্ট্রনীতির পথে এগোনোর জন্যেই পা ফেলছে।
লেখক: স্বদেশ রায়, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন