শিরোনাম
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম। শোষণের যাতাকলে নিষ্পেষিত পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র স্বস্তির বাতাবরণ হয়ে উঠেনি বরং হয়ে উঠেছিল ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ সমতুল্য।, বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে পড়া’। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই বাঙালিদের ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসনের নামে শোষণ, আঞ্চলিক বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়ন। পাকিস্তানের দুই অংশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জনমনস্তত্ত্বের দুরত্ব ছিল যোজন যোজন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিষ্পেষণ থেকে বাঙালিকে, বাঙলার হাজার বছরের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে বাঁচাতে অচিরেই মুসলিম লীগের বিপরীতে নতুন একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত তরুণ, যুবারা। বাঙালি তরুণ ও যুবাদের দাবি মেনে নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সময়ের প্রয়োজনে যে রাজনৈতিক সংগঠনটি জন্ম লাভ করে তার নাম ‘ আওয়ামী মুসলিম লীগ’। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হক। শেখ মুজিবুর রহমান কে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
প্রতিষ্ঠার পর খুব অল্প সময়ে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের মেধা, মনন ও কর্মদক্ষতায় আওয়ামী লীগ পরিণত হয় পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পূরণের লক্ষ্যে প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনা ধারণ ও আদর্শের মহত্তর পদক্ষেপ সম্বলিত প্রতিষ্ঠানে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃত্ব কুক্ষিগত ছিল অভিজাত ও সামন্ত প্রভুদের হাতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রাণ ভোমরাদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত তরুন, যাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল সাধারণ মানুষের। সঙ্গত কারনেই বাঙালি মনস্তত্ব প্রতিফলিত হয়েছিল আওয়ামী লীগে, যা ছিল চরিত্রগতভাবে পাকিস্তানি মনস্তত্ব থেকে ভিন্ন মাত্রিকতার।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে আওয়ামী লীগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে ভাষা আন্দোলন সূচিত হয় ১৯৫২ সালে তা গণজাগরণে পরিণত হয়। অব্যাহত রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার তরুণ সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময়ে কারান্তরালে থেকেও ভাষা আন্দোলনে প্রেরণাদাতার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের প্রণীত ২১ দফায় বাঙলা ও বাঙালিপ্রীতি ছিল স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। পূর্ব বাংলার মানুষের সামগ্রিক দাবি আর্থসামাজিক উন্নয়ন, ভাষা, সাহিত্য,সংস্কৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছিল বাঙালির স্বাধীকার।
আওয়ামী লীগ সমকালীন প্রেক্ষাপটকে কখনও এড়িয়ে যায়নি, বরং তাকে ধারণ করেই যুগের দাবি পূরণে তৎপর এই সংগঠনটি ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বাঙালি জনগণের মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে চলেছে নিরন্তর । নিরবচ্ছিন্ন এই সংগ্রামের ধারায় ১৯৬৬ সালের ৬-দফা, ৬৯-এর গনঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন সর্বোপরি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সকল কিছুই অর্জিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতির মূল ধারা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বহুতা নদীর ন্যায়, যার ¯স্রোতধারায় সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কালের যাত্রায় আওয়ামী লীগ সব সময় ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ভাঙনের শিকার হয়েছে। দল ও উপদল সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল সামরিক শাসকরা। বাঙালির প্রাণের স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস মুছে ফেলতে আওয়ামী লীগকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল চক্রান্তকারীরা। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সকল ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত কে উপক্ষো করে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে দল গঠনে মনোযোগ দেন। সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন, স্বজন হারাকে স্বজন বানিয়েছেন। নিরাশার বুকে আশা জুগিয়েছেন। অন্ধকারে আলো হয়ে পথ দেখিয়েছেন।
অনেক চড়াই-উতরায় পেরিয়ে শেখ হাসিনার সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ একদিকে দেশ গঠন করেছেন অন্যদিকে মনোযোগ দিতে হয়েছে ইতিহাস সংরক্ষণে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই তার কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের মহাসড়কে।
২১ ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা, সমুদ্রসীমা জয়, ছিট মহল সমস্যার সমাধান, স্যাটলাইটের নিজস্ব মালিকানা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বহু মেঘা প্রকল্প বাস্তবায়ন, দারিদ্র বিমোচন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূরীকরণসহ সুদূর প্রসারী সাহসী নেতৃত্বদানে বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকজন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে শেখ হাসিনা আজ অন্যতম।
৭৪ পেরিয়ে ৭৫ পদার্পন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জনকল্যানমুখী এই রাজনৈতিক দলের আজও আবেদন এতটুকুও কমেনি, বরং সময়ের সাথে পাল্লা তা বেড়েছে। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা বা ইতিহাসমুখীতা যেমন আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূলমন্ত্র, তেমনি যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে এই দলটি ইতিহাসের দায়মোচনেও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ‘general will' টার্মের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম আগেই। তবে আক্ষরিক অর্থে General will সমন্ধে পরিপূর্ণভাবে অবহিত হই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম, ইতিহাস ও বিকাশের মধ্য দিয়েই। General will হল সামগ্রিকভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জনগণের সামগ্রিক ইচ্ছার প্রতিফলিত রূপই যেন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।
কাওসার আহমেদ কৌশিক
সদস্য, তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ