জলদস্যু আতঙ্কে ঘুম হারাম ২০ হাজার জেলের

ফানাম নিউজ
  ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:৪২

উপকূলীয় জেলা বরগুনার সর্ব দক্ষিণের উপজেলা পাথরঘাটা। দেশের সামুদ্রিক মাছের চাহিদার বড় অংশ আসে এই উপজেলা থেকে। বঙ্গোপসাগর ও নদী থেকে এই উপজেলার বার্ষিক আহরিত মাছের পরিমাণ ১ লাখ ২২ হাজার ৮৮৩ মেট্রিক টন। ১২ হাজার ৩৪০টি পরিবারের অন্তত ২০ হাজার জেলে সরাসরি মৎস্য আহরণের সঙ্গে জড়িত। পরোক্ষভাবে মাছের ব্যবসায় সম্পৃক্ত আরও কয়েক হাজার।

গত দুই বছর নির্বিঘ্নে মাছ শিকার করতে পারলেও সম্প্রতি জলদস্যুদের উৎপাতে ঘুম হারাম জেলেদের। সাগরে গেলেই তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করছে জলদস্যুরা। লুণ্ঠন করছে আহরিত মাছ ও ট্রলারে থাকা অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী। কখনো জেলেদের অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন করে আদায় করছে মুক্তিপণ। অনেক সময় টাকা না পেয়ে হত্যা করা হচ্ছে জেলেদের। এ অবস্থায় সাগরে যেতেও ভয় পাচ্ছেন অনেক জেলে।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি বোটে তাদের ১৪-১৫ জনের একটি দল মাছ ধরতে যান। একবার সমুদ্রে গেলে ৫-১০ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন তারা। সমুদ্রে কিছুদূর গেলেই তাদের মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের বোটগুলোতে নেই ওয়্যারলেস সুবিধাও। জলদস্যুরা এই সুযোগটিই কাজে লাগায়। আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জেলেদের ওপর হামলা করে। বোটে থাকা মাছসহ সবকিছু নিয়ে নেয়। অনেক সময় অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকা থেকে নেওয়া হয় মুক্তিপণের টাকা।

জেলেরা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বিপদের কথা জানাতে পারেন না। ফলে বিপদকে নিত্যসঙ্গী করেই তাদের কাজ করতে হয়। এ অবস্থায় উপকূলকে নিরাপদ করতে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে প্রশাসন। সম্প্রতি র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই জলদস্যু নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে আরও অনেকে। দস্যুদের দমনে র‌্যাবের কঠোর অবস্থান জানান দিতে ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলতে রোববার পাথারঘাটায় যান র‌্যাব মহাপরিচালকসহ বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসন ও বরগুনা জেলা প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা।

পাথরঘাটা উপজেলা মৎস দপ্তর সূত্র জানায়, এখানে বার্ষিক মাছের উৎপাদন এক লাখ ৩২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাষযোগ্য মাছ মাত্র এক হাজার ৫৬১ মেট্রিক টন। বাকি মাছের পুরোটাই আহরিত। খাল থেকে আহরিত মাছ এক হাজার ২৮৬ মেট্রিক টন, নদী থেকে এক হাজার ৩৯৮ মেট্রিক টন এবং বঙ্গোপসাগর থেকে এক লাখ ২৮ হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন। মোট মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইলিশ। নদী থেকে আহরিত ইলিশের পরিমাণ ৬৭২ মেট্রিক টন এবং বঙ্গোপসাগর (মেরিন) থেকে আহরিত হয় ৮৫ হাজার ২৬০ মেট্রিক টন।

পাথারঘাটার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, মাছের এই বিশাল বাজার দেশের মোট মাছের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ২০ হাজার মৎস্যজীবী এখানে কাজ করছেন। এই বাজার ঘিরে ৬৬টি মৎস্য আড়ৎ ও ২১টি বরফকল গড়ে উঠেছে। মৎস্যজীবীদের এখন মূল সমস্যা জলদস্যুতা। যা মোট মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি করছে।

পাথরঘাটার হারিটানা গ্রামের বাসিন্দা ৩৩ বছর বয়সি আবদুর রহিম। ১৩ বছর বয়স থেকে শুরু করেন মৎস্য আহরণের কাজ। বর্তমানে আলম মোল্লার বোটে কাজ করেন। তিনি জানান, স্কুলের বারান্দায় কখনো পা রাখেননি। অভাবের সংসারে কিশোর বয়স থেকেই রোজগার শুরু করতে হয়েছে। মাসে দুবার তিনি ১৫ জনের দলের সঙ্গে সমুদ্রে যান। একবার সমুদ্রে গিয়ে বেশি মাছ শিকার হলে ৫-৬ দিন এবং কম হলে ১০ দিন পর্যন্ত সেখানে থাকেন তারা। অনেক সময় টানা ১০-১২ ঘণ্টা চালানো হয় বোট। সমুদ্রে পৌঁছানোর পর একবার জাল ফেলে কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা রাখা হয়। এরপর সেই জাল টেনে উঠাতে লাগে তিন ঘণ্টার মতো। যে মাছ ওঠে তা ধুয়ে বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। মাছ ধরার এ প্রক্রিয়ার মধ্যেই হয় ডাকাতি।

তিনি জানান, ২০-২২ দিন আগে সুন্দরবন উপকূলে ডাকাতদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তারা। পাশাপাশি চারটি বোট ওই এলাকায় মাছ ধরছিল। এর মধ্যে তাদের ছাড়া বাকি তিনটিতে আক্রমণ করে দস্যুরা সবকিছু নিয়ে যায়। ঘটনার সময় তাদের জাল পানিতে ফেলা অবস্থায় ছিল। ডাকাত দল যখন তাদের বোটের দিকে আসছিল তখন দা দিয়ে জাল কেটে ফেলে রেখে তারা বোট নিয়ে পালিয়ে আসে। এরপর ৩-৪ কিলোমিটার দস্যুরা তাদের বোটকে ধাওয়া করে। 

তিনি বলেন, আমাদের এলাকার ১০০ জন মানুষের ৮৫ জনই জেলে। দস্যুদের আক্রমণের কারণে এখন সমুদ্রে যেতেও ভয় করে। দস্যুরা না থাকলে মনে একটু শান্তি পাই।

৪৮ বছর বয়সি মো. খলিল গাজী ১৮ বছর ধরে সমুদ্রে মৎস্য আহরণের কাজ করছেন। যিনি সাগরে দস্যুদের দ্বারা পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন অচল জীবনযাপন করেছেন। সুস্থ হয়ে আবার ফিরেছেন কাজে। তিনি বলেন, মোট তিনবার দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। সর্বশেষ মহিপুরের পূর্বদিকে সন্ধ্যা নামার ক্ষণে আক্রমণের শিকার হই। ১৬-১৭ জনের একটি দল আমাদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের প্রত্যেকের কাছেই ছিল অস্ত্র।

আমরা নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম। ফলে কাউকে জানানোরও সুযোগ ছিল না। তিনি আরও জানান, আমাদের আয় খুবই সামান্য। ইলিশের ক্ষেত্রে লাভের ১৬ ভাগের মাত্র ছয় ভাগ আমরা পাই। চিংড়ির ক্ষেত্রে সেটা অর্ধেক। সমুদ্রের গভীরে গেলে একবারে তাদের খরচ হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। আবার কাছাকাছি থাকলে খরচ হয় দেড় লাখ টাকার মতো। অনেক সময় এমনো হয়েছে যাওয়া-আসার খরচও ওঠেনি। এ অবস্থায় দস্যুতা না থামালে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।

র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার পর আমরা ভেবেছিলাম এমন ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু দস্যুরা থেমে নেই। আমরা হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে, সাগরও দস্যুমুক্ত হবে। এখনো যারা এই কাজে জড়িত আমরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানাই। আমরা তাদের সহযোগিতা করব। এর পরেও যদি দস্যুতা হয় আমরা কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা নেব।

পাথরঘাটার নতুন বাজার লঞ্চঘাট এলাকায় কথা হয় এফভি আল্লাহর দান বোটে বাবুর্চির কাজ করা সগীর ফরাজীর সঙ্গে। তিনি জানান, গত দুই বছর ধরে নিরাপদেই মৎস্য আহরণ করছিলেন তারা। কিন্তু সম্প্রতি বেড়েছে জলদস্যুদের উৎপাত। জলদস্যুরা এসে মারধর করে নৌকার মালামাল নিয়ে যায়। অনেক সময় হাত-পা ভেঙে দেয়।

হাসান শিকদার নামের আরেক জেলে জানান, মোট পাঁচবার জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। ইদানীং তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পার্টির (ডাকাত) লোকজন কোথা থেকে আসে তা জানি না। তবে তারা খুবই হিংস । অস্ত্র নিয়ে তারা আক্রমণ চালায়। শিকার করা মাছ, আমাদের খাওয়ার চাল-ডাল, এমনকি ব্যবহৃত সামগ্রীও অনেক সময় নিয়ে যায়।

১০ বছর ধরে মাছ ধরার বোট চালান মো. হিরু দফাদার। তিনি বলেন, ভারতের সব বোটেই ওয়্যারলেস থাকে। ফলে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু আমরা গভীর সমুদ্রে গেলে কোনো নেটওয়ার্ক পাই না। তাই আমাদের সঙ্গেই এমন হয়।

নেসার উদ্দিন নামের এক জেলে বলেন, চার দিন আমাকে জলদস্যুরা আটকে রাখে। এ সময় নির্মম নির্যাতন করে। এরপর পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চায়। পরে তিন লাখ টাকায় চুক্তি হয়। এরপর মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।

জেলে কামালের মা আম্বিয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলেকে আটকে রেখে মারধর করে জলদস্যুরা। নির্মম নির্যাতন করে মোবাইল ফোনে কল করে আমাকে কান্নার আওয়াজ শোনায়। তিন লাখ টাকা দাবি করে। আমি বহু কষ্টে তাদের ৫০ হাজার টাকা দেই। তারা তা না মেনে আরও আড়াই লাখ টাকা চায়। পরে র‌্যাব গিয়ে আমার ছেলেকে উদ্ধার করে।

বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন পর ফের দস্যুতা বেড়েছে। এজন্য যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের ওপর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে দ্রুতগতির যান ও র‌্যাবের ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। বাড়াতে হবে টহল। পাশাপাশি উপকূলে দুটি সিগন্যাল লাইট স্থাপন করারও দাবি জানান তিনি।

বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, জলদস্যুদের দমনে র‌্যাব সর্বশক্তি নিয়ে কাজ করছে। আমরাও সব ধরনের সহযোগিতা করছি।

পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এসএম আক্তারুজ্জামান বলেন, আমরা জেলেদের আশ্বস্ত করতে চাই বেশি দিন তাদের দুঃখ থাকবে না। শিগগিরই সমুদ্রও দস্যুমুক্ত হবে। জেলেরা নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারবেন।

বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, অনেক সময় জেলেদের নিখোঁজের খবর আমরা পাই। কিন্তু তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যেহেতু তারা নিখোঁজ তাই তাদের মৃতও বলা যায় না। ফলে তাদের পরিবার কোনো সরকারি সুবিধাও পায় না।

আড়ৎদার মালিক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন জমাদ্দার বলেন, জলদস্যুদের জন্য জেলেরা অতিষ্ঠ। একের পর এক ঘটনা ঘটছেই। আমরা এখানে র‌্যাবের ক্যাম্প চাই। তা ছাড়া এদের দমন সম্ভব নয়। পাথরঘাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হোসেন আকন্দ বলেন, জেলেদের মূল সমস্যা জলদস্যু। এটার সমাধান হলে মৎস্য আহরণে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।

সূত্র: যুগান্তর