সুদিনে ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশ রেশম বোর্ড

ফানাম নিউজ
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০৯

নানা জটিলতার কারণে ২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার বন্ধ করে দেয় রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী রেশম কারখানা। টানা ১৬ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সালে পুণরায় চালু হয় কারখানাটি। রাজশাহীতে রেশমের ঐতিহ্যের কারণে ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতিও মেলে। এতে বর্তমান সরকার ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের সুদিন ফেরাতে একনেকে পাস করে ১৫৩ কোটি টাকার ৪টি প্রকল্প। এতে আবারও সুদিনের অপেক্ষায় বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড।

রেশম বোর্ডের ভাষ্যমতে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর রেশম কাপড়ের চাহিদাও বেড়েছে। বর্তমানে রেশম চাষিদের উৎপাদিত রেশম গুটি থেকে কারখানার সামনের রেশম ডিসপ্লেতে মিলছে খাঁটি রেশম পণ্য যেমন- প্রিন্টেড শাড়ী, টু-পিস, থান কাপড়, ওড়না, স্কার্ফ, টাই ইত্যাদি।

বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের ইতিহাসের পাতা উল্টে জানা গেছে, একসময় ভারতীয় উপমহাদেশসহ আন্তর্জাতিক বাজারে রেশম বস্ত্রের বেশ কদর ছিল। সে প্রেক্ষাপটে বৃটিশরা ১৮৯৮ সালে রাজশাহীতে একটি রেশম কারিগরি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তির পর সাবেক পূর্ব পাকিস্তান দুটি রেশম নার্সারি করে, যার একটি বগুড়ায় অন্যটি রাজশাহীর মীরগঞ্জে করা হয়।

রেশম উৎপাদন প্রকল্প ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। এই নতুন উদ্যোগের অধীনে ভোলারহাট, নবাবগঞ্জ, ঈশ্বরদী, রংপুর, দিনাজপুর, কোনাবাড়ী, ময়নামতি, সিলেটের খাদিমনগর, ভাটিয়ারি ও চন্দ্রঘোনায় মোট ১০টি নতুন নার্সারি স্থাপিত হয়।

অতঃপর ২২টি সম্প্রসারণ কেন্দ্র, একটি রেশম কারখানা ও একটি রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে রেশম কারিগরি ইনস্টিটিউটটি রেশম ও লাক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে দুটি ইউনিটে গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনার প্রেক্ষিতেই ১৯৭৭ সালে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক ড. এম. এ মান্নান বলেন, রেশম শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ও জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বর্তমানে গবেষণা কার্যক্রমসহ রেশম সম্প্রসারণে প্রায় ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীসহ সারাদেশে ৪টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে রেশম চাষ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে পার্বত্য জেলাসমূহে আদিবাসী ও আদিবাসী নয় এমন হতদরিদ্র ১০ হাজার ব্যক্তির কর্মসংস্থান অন্যতম।

এছাড়া পার্বত্য জেলাসমূহে রেশম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১২ মেট্রিক টন কাঁচা রেশমের নতুন উৎস সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলমান। বৃহত্তর রংপুর এলাকায় ১৫ হাজার হতদরিদ্র ও ভূমিহীন বিশেষ করে নারীদের রেশম চাষে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর আরেকটি প্রকল্প চলমান। এতে রেশমের বিভিন্ন বিষয়ে দুই হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে রেশম চাষের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ মেট্রিক টন কাঁচা রেশমের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব যা দেশীয় চাহিদা পূরণ করবে।

এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশ রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এ সমন্বিত প্রকল্পের আওতায় আনা হবে হতদরিদ্র ও ভূমিহীনদের, বিশেষ করে নারীদের। এতে করে রেশম চাষ বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে।

শুধু তাই নয়, এসকল হতদরিদ্র মানুষদের রেশম চাষের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তাদের দ্বারা রেশম গুটি ও কাঁচা রেশমের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।

তিনি জানান, রেশমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফার্মিং পদ্ধতিতে রেশম চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে তুঁতচাষ বৃদ্ধিসহ রেশম গুটি ও সূতা উৎপাদন কাজে নিয়োজিত তুঁতচাষি ও সংশ্লিষ্টদের উপযুক্ত সহায়তা প্রদান হচ্ছে। এর ফলে রেশম পণ্য বাজারজাতকরণের সুযোগ ও নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা সুমন ঠাকুর জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে রেশম চাষিদের রেশম ডিমসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামাদি বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। এমনকি পলু পালনের জন্য পলু ঘরও রেশম চাষিদের তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে ৩৫টি আইডিয়াল রেশম পল্লী ও ৪৯৬টি তুঁতব্লক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ফার্মিং পদ্ধতিতে রেশমের চাষ হচ্ছে। এতে উৎপাদন বাড়ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড ৫টি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৭টি জোনাল কার্যালয়, ৪১টি রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের মাধ্যমে রেশম সম্প্রসারণের কাজ করছে বলেও জানান জনসংযোগ কর্মকর্তা।

রাজশাহী রেশমের মানের বিষয়ে কারখানার সুপারভাইজার মো. টুটুল বলেন, আমাদের রেশমের কাপড়ের সঙ্গে বাইরের রেশমের কাপড়ের তুলনা করা বোকামি। আমাদের তৈরিকৃত পণ্যে চুল পরিমাণ ভেজাল নেই। তাই এখান থেকে কাপড় কিনলে কেউ ঠকবে না।

এদিকে রেশম বোর্ডের প্রধান উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বিভাগের কর্মকর্তা জেরিন মৌসুমী কান্তা বলেন, ২০১৮ সালে কারখানা চালু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২৩ হাজার ৫০০ মিটার কাপড় উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে আভ্যন্তরীণ সুতার চাহিদা রয়েছে ৩০০ মেট্রিক টন। চলমান ৪টি প্রকল্প থেকে আরও ৪১ মেট্রিক টন রেশম গুটি উৎপাদন সম্ভব হবে। এ পর্যন্ত গুটি উৎপাদন হয়েছে ১৬.৭৯ লাখ কেজি এবং তা থেকে রেশম সুতা তৈরি হয়েছে ১২ হাজার ২১১ কেজি। এছাড়া রাজশাহী রেশম কারখানায় এপর্যন্ত কাপড় উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ৩৮৩ মিটার।

তিনি বলেন, রাজশাহী রেশম কারখানায় প্রায় ৪১ জন দৈনিক মজুরি ভিত্তিক শ্রমিক কাজ করছে। এখানে চায়না ও কোরিয়া থেকে ষাটের দশকে কেনা ৪৩টি তাত মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি মেশিন পুনরায় ঠিক করে তাতে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৫৫ গজ কাপড় উৎপাদন হচ্ছে। মাসে হিসেবে ১২০০-১৩০০ গজ কাপড় উৎপাদন হয়। ২০১৮ সালে কারখানা চালুর পর থেকে প্রায় ৬০ লাখ টাকার কাপড় বিক্রি হয়েছে।

তিনি আরও জানান, রেশমজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক বিক্রয়ের ব্যবস্থা হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী ও গাজীপুরে রেশম পণ্যের দুটি শো-রুম রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক জিআই সনদ প্রাপ্তির পর রেশম কাপড়ের চাহিদা বেশ বেড়েছে।

পরিচালক ড. এম এ মান্নান বলেন, রেশমের পুরনো ঐতিহ্য, গুণগত মান ও জনপ্রিয়তার কারণে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে রেশম কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। অভিজাতদের প্রথম পছন্দ রেশমজাত পণ্য। তবে প্রচার প্রচারণার অভাবেই আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি পিছিয়ে আছে। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সময়োপযোগী নতুন পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। লক্ষ্য রয়েছে পুনরায় রেশম শিল্পের সুদিনে ফেরার।

সূত্র: জাগো নিউজ