শিরোনাম
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের খুদিরকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর বিয়ে হয় একই ইউনিয়নের পূর্ব দই খাওয়ার চর গ্রামের ২০ বছর বয়সী এক যুবকের সঙ্গে। সহপাঠী ও প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে খেলাচ্ছলে পুতুলের বিয়ে দেওয়া কিংবা ভাঙা তৈজসের টুকরো দিয়ে বাড়ির আঙিনায় দাগ কেটে কুত কুত খেলার বয়সে বাল্যবিয়ে নামক অভিশাপের বলি হয় সে। ওই শিশুকন্যাটির জন্য স্বামী-সংসার যে সুখানুভূতি নয় বরং আতঙ্কের—সেটা বিবেচনায় নেয়নি কোনও পক্ষই। পরিণতি— দু’বছরের মাথায় বিবাহ বিচ্ছেদ।
‘আমার বিয়ে নিজের ইচ্ছায় হয় নাই। আমি ও আমার ভাই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। মা আর দুলাভাইয়ের চাপে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। আমি বুঝেছি, বাল্যবিয়ে হলে মেয়েরা কোনও দিন সুখী হতে পারে না’— বাল্যবিয়ের শিকার শিশুটি এভাবেই নিজের ভাগ্য বিড়ম্বনার গল্প জানায়। বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও সহসাই আর বিয়ের পিড়িতে বসতে রাজি নয় সে।
স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এই ছাত্রী লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে নামক শব্দটি আর মুখে নিতেও নারাজ সে।
‘আমি এখন আর বিয়ে করতে চাই না। পড়াশুনা করতে চাই। উপযুক্ত বয়স হলে বিয়ের কথা ভাববো’- জানায় ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী।
কিন্তু অত অল্প বয়সে কীভাবে বিয়ে হলো, রেজিস্ট্রি হয়েছিল- এমন প্রশ্নে সম্মতির ইশারা দেয় ভুক্তভোগী মেয়েটি। জানায়, জন্ম নিবন্ধন কার্ডে বয়স বাড়িয়ে কাবিন হয়। তার জন্ম সাল ২০০৭ হলেও কাবিনে জন্মসাল ২০০৩ দেখিয়ে ১২ বছর বয়সেই তার বিয়ে নিবন্ধন করা হয়।
কী ছিল ওই ছাত্রীর বিয়ের কাবিননামায়?
কাবিননামা চাইলে মেয়েটির মা ঘর থেকে একটি কপি নিয়ে আসেন। হাতে নিয়ে দেখতেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার অবস্থা। জন্মসাল, বয়স এবং জন্ম নিবন্ধন নাম্বার পরিবর্তন করে কাবিন করা হয়েছে। দেনমোহর ১ লাখ টাকা ধার্য করে ৯৮ হাজার ৩শ’ টাকা বাকি রাখা হয়েছে। ভুক্তভোগী স্কুল ছাত্রীর চেহারায় শিশু বয়সের স্পষ্টতা থাকার পরও বিয়ে নিবন্ধন করেছেন স্থানীয় কাজি মাওলানা মো. মকিবুর রহমান।
এমন গল্প কুড়িগ্রামের সব উপজেলার পাড়ায়-মহল্লায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ বাল্যবিয়ের আইনগত বৈধতা থাকছে না। ফলে নারী নির্যাতন আর বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনায় আইনগত কোনও প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী এসব স্কুলছাত্রী।
যেভাবে সম্পন্ন হচ্ছে বাল্যবিয়ে
বাল্যবিয়ের শিকার স্কুলছাত্রী, তাদের পরিবার, বিয়েতে উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট কাজিদের সঙ্গে কথা বলে জেলায় বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হওয়ার বেশ কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে জানা গেছে। কারও ভুয়া জন্ম-নিবন্ধন সনদে নকল নিবন্ধন বইয়ে বিয়ে ‘রেজিস্ট্রি’ হচ্ছে আবার কারও নিবন্ধন ছাড়াই বিয়ে হচ্ছে।
জেলার সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের বাল্যবিয়ের শিকার নবম শ্রেণির এক ছাত্রী (১৫) জানায়, তার বিয়েতে কাজি এসেছিলেন এবং সে কাবিনে স্বাক্ষরও করেছিল। তবে বিয়েতে যে কাজি উপস্থিত ছিলেন তাকে সে চেনে না।
ওই ইউনিয়নের কাজি রফিকুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নিজ ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাল্যবিয়ে পড়াই না। গোপনে এবং অনেক সময় অন্য এলাকায় নিয়ে এসব বিয়ে পড়ানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব বিয়ে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই হয়।’
আর বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর বিয়ে নিবন্ধনকারী কাজি মাওলানা মো. মকিবুর রহমান বলেন, ‘২০১৯ সালের ঘটনা আমার মনে পড়ছে না। যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে এমনটা আর হবে না। সম্প্রতি আমরা ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে শপথও করেছি।’
তবে সদর উপজেলার এক কাজি নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, জেলার প্রত্যেক কাজির কাছে সরকারি ভলিউমের হুবহু নকল আরও একটি ভলিউম থাকে। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে কাজিরা ওই নকল ভলিউম নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যান এবং সেই ভলিউমে বিয়ে নিবন্ধন করেন। কনে ও বর পক্ষকে দেখানোর জন্য এসব ভলিউমে বিয়ে নিবন্ধন করা হলেও প্রচলিত আইনে এসব বিয়ের কোনও বৈধতা থাকে না। মেয়ের বয়স ১৮ পূর্ণ হলে কাজিরা হাল তারিখে মূল ভলিউমে এসব বিয়ে নিবন্ধন করেন।
‘বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে কাজিরা অনেক সময় নিজে উপস্থিত না হয়ে তাদের প্রতিনিধি (ছায়া কাজি) পাঠিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করেন। বয়স কম হওয়ায় সরকারি ভলিউমে এসব বিয়ে নিবন্ধন না করে নকল ভলিউমে এসব বিয়ে নিবন্ধন করা হয়। ফলে বাল্যবিয়ের শিকার এসব মেয়েদের দাম্পত্য জীবনের আইনত কোনও বৈধতা নেই।’- যোগ করেন ওই কাজি।
নকল ভলিউম প্রসঙ্গে ওই কাজি বলেন, ‘অনেক সময় পরিস্থিতির কারণে আমিও বাল্যবিয়ে পড়াতে বাধ্য হই। আমার নিজের কাছে ভলিউম নেই। তবে ভলিউমের পৃষ্ঠার হুবহু কিছু পৃষ্ঠা রয়েছে। বাল্যবিয়ে পড়ানোর ক্ষেত্রে এসব পৃষ্ঠায় বিয়ে নিবন্ধন করা হয়। পরে বয়স পূর্ণ হলে মূল ভলিউমে কাবিন সম্পন্ন করা হয়।’
এলাকায় বাল্যবিয়েতে উপস্থিত থাকেন এমন কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রশাসনের নজর এড়ানোর জন্য অনেক সময় এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নের কাজির কাছে গিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। এক্ষেত্রে কনেকে বাড়িতে রেখে তার অভিভাবকসহ বরকে কাজির কাছে নিয়ে গিয়ে বিয়ে নিবন্ধন করা হয়। বর ও কনে পক্ষকে হুবহু নকল ভলিউমে বিয়ে নিবন্ধন দেখানো হয়। যে কাবিনের নকল কাজিরা কোনও পক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন না। মেয়ের বয়স ১৮ পূর্ণ হলে মূল ভলিউমে বিয়ে নিবন্ধন করে কাবিনের নকল দেওয়া হয়।
মাঠ প্রশাসনও জানে কীভাবে বাল্য বিয়ে হচ্ছে
করোনাকালীন সময় জেলায় বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় প্রশাসন। বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হওয়ার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে তারা অবগত হলেও করোনাকালীন সময়ে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সময়মত বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার খবর না পাওয়ায় এসব বিয়ের বেশিরভাগই ঠেকানো সম্ভব হয়নি বলে জানান প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরে তাসনিম (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) বলেন, ‘প্রত্যেক ইউনিয়নে কাজি এবং ইমামের বিকল্প লোক আছেন। অনেক সময় কাজিরা বাল্যবিয়েতে না গিয়েও অন্যদের দিয়ে বিয়েগুলো পড়াচ্ছে। যেগুলোর বেশিরভাগের বৈধ কোনও নিবন্ধন হয় না।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘কাজিদের নিয়ে আমরা মত বিনিময় করছি। তাদের শপথও করানো হচ্ছে। ছায়া কাজিদের (কাজিদের সহকারী) তথ্য সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনও কাজি বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রির দায় স্বীকার করতে চান না। তারা একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দেন।’
চরাঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানদের বাল্যবিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি এবং এসব বিয়ে নিবন্ধনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কাজিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে যাওয়ায় এখন বিয়ের প্রবণতা কমবে বলে আশা করছি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমরা সকল পর্যায়ের কমিটিগুলোকে সক্রিয় করে এটি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন