শিরোনাম
কয়েকদিন ধরে হবিগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ একেবারেই কম। এ কারণে এখানকার অর্ধশতাধিক শিল্প-কারখানার বিভিন্ন ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। যেগুলোতে উৎপাদন চলছে সেগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফলে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট পণ্যের অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে। এখন বিভিন্ন কারখানায় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের অনেকটা অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মালিকপক্ষ তাদের না পারছেন ছাঁটাই করতে, না পারছেন কাজে লাগাতে। বসিয়ে রেখেই তাদের বেতন দিতে হচ্ছে।
প্রাণ আরএফএলের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মহাব্যবস্থাপক দিপক কুমার দেব জানান, এখানে প্রতিদিন ১৫০ পিএসআই গ্যাস থাকার কথা। কিন্তু থাকছে মাত্র ১২ থেকে ১৫ পিএসআই। ৪০-৫০টি মেশিন নিয়মিত চলত। কিন্তু এখন অর্ধেক চালানো সম্ভব হয়। উৎপাদনও অর্ধেকে নেমে গেছে। প্রায় ৭ হাজার কর্মী বেকার সময় কাটাচ্ছে। এখন একটি কঠিন সময় পার করছি আমরা। তিনি বলেন, এখানে শিশুখাদ্য, মেডিকেলে ব্যবহার্য্য পণ্য উৎপাদন হয়। এগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। দ্রুত গ্যাস সংকটের সমাধান না হলে কারখানাগুলো মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
স্কয়ার ডেনিম ও স্পিনিংয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল বাবুল জানান, তাদের উভয় কোম্পানিতে ঘণ্টায় ২৪৯১ কিউবেক করে গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু দুদিন ধরে স্পিনিংয়ে কোনো গ্যাস পাচ্ছেন না। আর ডেনিমে পাচ্ছেন ১৪৯৫ কিউবেক। আবার ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইনে স্পিনিংয়ে ১৬৩৫ এবং ডেনিমে ২২৫৮ কিউবেক প্রয়োজন। কিন্তু কোনো গ্যাস মিলছে না। এ অবস্থায় স্পিনিং কারখানাটি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। আবার ডাইং এবং ফিনিশিংও বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতি আর দুদিন থাকলে সব কারখানায়ই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, স্কয়ার রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন করে। গুণগত মানও সর্বোচ্চ রাখা হয়। এভাবে চলতে থাকলে অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে। ক্রেতাদের আস্থা কমে যেতে পারে। এতে বৈদেশিক আয়েও বড় ধাক্কা লাগবে।
স্টার ফোরসেলিনের প্রডাকশন ম্যানেজার শাহাদাত মিঠু বলেন, আমাদের কারখানা অনেক ছোট। তারপরও মাঝে মাঝেই গ্যাস সমস্যায় পড়তে হয়। এতে যেমন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে, তেমনি যন্ত্রপাতিও বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিল্পাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা না করলে বৈদেশিক আয় মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
পাইওনিয়ার ডেনিমসের হেড অব এডমিন এইচআর কমপ্লাইন মো. খায়রুল আলম রাব্বি জানান, তাদের দৈনিক যে গ্যাসের প্রয়োজন তার ৪০ শতাংশেরও নিচে পাচ্ছেন। ফলে কিছু প্ল্যান্ট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানটির পণ্য সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, সময়মতো শিপমেন্ট না করতে পারলে বিমানে দিতে হবে। এতে ডেলিভারি খরচ অনেক বেড়ে যাবে।
এসএম স্পিনিং মিলসের প্রধান অপারেটিং কর্মকর্তা (প্ল্যান্ট) আবুল বাশার জানান, তাদের কোম্পানিতে ঘণ্টায় ১৭২৮ মিটার কিউবেক গ্যাস সরবরাহের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু গত জুন মাসে তারা ১.২ মিলিয়ন মিটার কিউবেক ব্যবহার করতে পেরেছেন। তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপটিভ প্ল্যান্ট ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। এখানে প্রয়োজনের তুলনায় এখন প্রতিদিন পাচ্ছেন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ গ্যাস। এতে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ বিনা নোটিশেই গ্যাস কমিয়ে দিয়েছে। তাদের বলেছি লিখিত জানাতে। কিন্তু তারা তা করছে না। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে অর্ডার ডেলিভারি, শিপমেন্ট শিডিউল এগুলো বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে এখন রপ্তানি খাত থেকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, এখানকার ফ্যাক্টরিগুলোর সবগুলোই অটোমেটিক অত্যাধুনিক মেশিনে চলে। বারবার গ্যাসের ড্রপিংয়ের ফলে এসব মেশিনে সমস্যা দেখা দেয়। একটি যন্ত্র নষ্ট হলে তা আবার বিদেশ থেকে আনতে হয়। কারণ এগুলো এখানে পাওয়া যায় না।
জানতে চাইলে জালালাবাদ গ্যাস টিঅ্যান্ডডি সিস্টেম লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রকৌশলী খান মো. জাকির হোসাইন বলেন, জাতীয় গ্রিড থেকেই বরাদ্দ কমে গেছে। তাছাড়া লাইনের ধারণক্ষমতাও কম। উৎপাদনও কমে গেছে। এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ৩শ থেকে ৪শ এমএমসিএফটি গ্যাস সরবরাহ কম হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে কিছু কম দিয়ে এখন কাভার করা হচ্ছে। আগে প্রথমে দেওয়া হতো ৪২৫ এমএমসিএফটি। এরপর ৩৯১ এমএমসিএফটিতে নামিয়ে আনা হয়। এরপর ৩৮৭ এমএমসিএফটি এবং বর্তমানে দেওয়া হচ্ছে ৩৭৫ এমএমসিএফটি। তিনি বলেন, এলএনজি আমদানি করতে পারলে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
জানা যায়, জেলার নবীগঞ্জ, বাহুবল, হবিগঞ্জ সদর এবং শায়েস্তাগঞ্জ থেকে মাধবপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। গ্যাস এবং বিদ্যুতের সহজলভ্যতার কারণে এসব এলাকায় ২০১০ সালের পর থেকে দেশের স্বনামধন্য বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ এখানে কারখানা স্থাপন করে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই রপ্তানিমুখী। কিছুদিন ধরে গ্যাস সংকটের মুখে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। এতে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যন্ত্রপাতিও বিকল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রপ্তানি আয়ও কমে যাওয়ার উপক্রম। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিদেশি ক্রেতারা এক সময় মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
সূত্র: যুগান্তর