শিরোনাম
গাজীপুরে প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। মরদেহ দুটির ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মো. শাফি মোহাইমেন। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে লাশ দুটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। এ সময় দুজনের ফুসফুস ও কিডনিতে প্রায় একই রকম লক্ষণ পাওয়া গেছে। তাদের দুজনেরই ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া যায়। এটা সাধারণত খাদ্য বিষক্রিয়া কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। তাই তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
টঙ্গীর শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একেএম জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষক মাহমুদা আক্তার জলির লাশ বৃহস্পতিবার ভোরে গাজীপুর মহানগরীর গাছার দক্ষিণ খাইলকুরের বগারটেক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা তাদের প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। পরিবার বলছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পুলিশ বলছে এই মৃত্যু রহস্যঘেরা।
নিহত শিক্ষক দম্পত্তির ছেলে মো. মিরাজ সাংবাদিকদের জানান, গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়ি থেকে বুধবার সকালে একই প্রাইভেটকারে শিক্ষক দম্পতি তাদের স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হন। স্কুল শেষে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু এর পর থেকে তাদের কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বজনরা রাতভর খোঁজাখুঁজি করেও কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। ভোররাতের দিকে গাজীপুর মহানগরের গাছা থানার দক্ষিণ খাইলকুর বগারটেক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা তাদের গাড়ির ভেতর চালকের আসনে প্রধান শিক্ষক ও পাশের আসনেই স্ত্রীর নিথর দেহ দেখতে পেয়ে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেন। তাদের প্রথমে বোর্ডবাজার এলাকার তায়রুন্নেছা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উত্তরার অপর একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
নিহত একেএম জিয়াউর রহমানের ভগ্নিপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ বলেন, ইতিপূর্বে গাজীপুরের কালীগঞ্জের পুনসই হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেখান থেকে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার স্ত্রী মোসাম্মৎ মাহমুদা আক্তার জলিও টঙ্গী বাজার এলাকার আমজাদ আলী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা সপরিবারে থাকতেন গাছা থানার কামারজুড়ি এলাকার নিজ বাড়িতে।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে করে তারা দুজনেই স্কুলে যাওয়া আসা করতেন। বুধবার স্কুল শেষে সহকর্মী ও সম্পর্কিত মামাতো ভাই মো. কামরুজ্জামানকে (গণিতের শিক্ষক) গাড়িতে তুলে নিয়ে জিয়াউর যান স্ত্রী জলির স্কুলে। সেখান থেকে স্ত্রী জলিকে গাড়িতে তুলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন এ দম্পতি। পথে কামরুজ্জামানকে নামিয়ে দেন জিয়াউর। জিয়ার ছেলে মিরাজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে পৌনে ৭টার দিকে বাবার মোবাইলে ফোন দেন। কিন্তু বাবার ফোন রিসিভ না হওয়ায় তার মায়ের ফোনে কল করেন। পরে মা ফোন ধরে বাসায় আসছেন বলে জানান। কিন্তু মা কথা বলার সময় ক্লান্তির স্বর ভেসে আসছিল। এর পর থেকে ফোনে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি। পরে তারা গাছা থানা, টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানায় যোগাযোগ করেন। রাতভর তারা বিভিন্ন জায়গায় তাদের খোঁজ করেন।
টঙ্গীর শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. নুরুজ্জামান রানা বলেন, প্রধান শিক্ষক একেএম জিয়াউর রহমান ও কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। জিয়াউর স্যার গাছা থানার কামারজুড়ি এলাকায় এবং কামরুজ্জামান টঙ্গীর শিলমুনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কামরুজ্জামান একই স্কুলের গণিতের সহকারী শিক্ষক। জিয়াউর স্যারও গণিতের শিক্ষক ছিলেন। কামরুজ্জামান হেডস্যারকে মামাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন। তবে স্বামী-স্ত্রী কিংবা স্কুলের সব শিক্ষকের সঙ্গেই জিয়া স্যারের ভালো সম্পর্ক ছিল। কারও সঙ্গে কখনো বিরোধ ও খারাপ সম্পর্কের কথা শুনিনি।
সহকারী শিক্ষক কামরুজ্জামান বলেন, স্কুলের পাশে প্রাইভেট পড়ানো শেষ করে বুধবার বিকাল সাড়ে ৬টার দিকে স্কুলে টয়লেট ব্যবহার করতে যাই। টয়লেট সেরে স্কুলের গেটের কাছে গেলে হেডস্যার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্কুল থেকে বের হন। পরে তিনি পথে নামিয়ে দেবেন বলে তার গাড়িতে উঠতে বলেন। আমাকে নিয়ে তার ম্যাডামকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন হেডস্যার। হেডস্যার নিজেই গাড়ি চালান। পথে টঙ্গী বিসিকের সাহারা মার্কেট এলাকায় গিয়ে আমাকে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে নামিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছেন। এর পর আমার সঙ্গে তাদের আর কথা বা দেখা হয়নি। কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার পলাশতলি গ্রামে। তিনি শিলমুন এলাকায় ভাড়া বাসায় সপরিবারে বসবাস করেন। আর হেডস্যার গাছা থানার কামারজুড়ি এলাকায় নিজ বাড়িতেই সপরিবারে বসবাস করেন। তার গ্রামের ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায়।
নিহতের বড় ভাই মো. রিপন সাংবাদিকদের বলেন, এটি পুরোপুরি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন কিছুই খোয়া যায়নি। ঘটনাটি যদি পরিকল্পিত না হতো তা হলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইল ও গাড়ি নিয়ে যেত। তার কিছুই তারা নেয়নি।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) আবু সায়েম নয়ন জানান, তাদের লাশে সুরতহাল প্রতিবেদন করা হয়েছে। তবে তাদের লাশে মৃত্যুর কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। পাশে একটি খালি বাটি পাওয়া গেছে। তবে তাতে কী ছিল তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ময়নাতদন্তের পর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, ঘটনাটি তদন্তে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।