শিরোনাম
রাজধানীর হাতিরঝিলের সড়কে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা নামিয়ে এক শ্রেণির মালিক মাসে মাসে কোটি টাকা মুনাফা লুটে নিচ্ছে। অন্যদিকে এসব রিকশা চালিয়ে অসহায়-গরিব চালকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত টাকা রোজগার করতে পারছে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করলেও তারা সময়ে-অসময়ে নিরাপত্তারক্ষীদের টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়া রিকশা-মালিকদের দাবি মেটাতে গিয়ে তাদের পকেট কাটা পড়ছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারছে না।
হাতিরঝিলের পাশের পুলিশ প্লাজা থেকে শুরু করে ঝিলের রাস্তা ধরে বাড্ডা ও গুদারাঘাট পর্যন্ত তিন শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। রাস্তায় রিকশা নিয়ে নামলেই চালককে দিনে রিকশা-মালিককে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে জমা দিতে হয়। এছাড়া ‘প্রতিরোধকারী সংস্থার সদস্য’ ও ‘আনসার’ সদস্যরা তাদের পকেট কাটে। জরিমানাও চালকদেরই গুনতে হয়। নিরুপায় হয়ে সব সহ্য করে, সব জেনেশুনেই অসহায় মানুষগুলো রিকশা চালান।
রাজধানীতে বিশেষ করে হাতিরঝিলে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপটের কথা পুলিশসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যই জানে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে পুলিশ প্লাজা থেকে শুরু করে সড়ক সেতু হয়ে ঝিলঘেঁষা রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা এগুলো চলাচল করে। হাতিরঝিলের সঙ্গে প্রায় ২২টি সড়ক যুক্ত। একাধিক রিকশাচালক জানান, এ সড়কে বৈধ অথবা অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে বাধা রয়েছে। টাকা না দিলে এক শ্রেণির ‘আনসার’ ও ‘নির্ধারিত লোক (অবৈধ রিকশা মালিকের নিয়োগ করা লোক)’ সড়কগুলোতে রিকশা চলতে দেয় না।
রিকশাচালক সেলিম মিয়া জানান, এ সড়কে রিকশা চালালে বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। পুলিশ প্লাজা মোড় থেকে গুদারাঘাট পর্যন্ত ৭০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। প্লাজা মোড় থেকে প্রতিটি রিকশাকেই ঘুরতে হয়। প্লাজাসংলগ্ন সেতু পার হয়ে মোড়ে এসে যাত্রী তুলতে হয়। এখানে সব সময়ই যাত্রী পাওয়া যায়। এজন্য সব রিকশাচালক মোড় পর্যন্ত আসেন। আর মোড়ে আসামাত্র আনসার সদস্যদের ১০টা করে দিতে হয়। এ টাকা না দিয়ে কোনো চালকই যাত্রী নিতে পারেন না। আবার কোনো কারণে মোড় পার হয়ে প্লাজার সম্মুখে গেলেই ট্রাফিক পুলিশ রিকশা আটক করে। এ কারণে ৬০০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়। মোড়ে কখনো কখনো ট্রাফিক পুলিশও হানা দেয়। মোড় থেকে রিকশা তুলে নিয়ে যায়। এখানেও পুলিশ বাণিজ্য করে। কেমন বাণিজ্য হয়-এমন প্রশ্ন করতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রিকশাচালক বলেন, এ মোড়ে চারজন আনসার সদস্য ও ‘ক্ষমতাবানদের’ দুজন লাইনম্যান থাকে। তাদের টাকা প্রতিদিনই দিতে হয়। ট্রাফিক পুলিশ রিকশা আটক করলে আনসার সদস্য ও লাইনম্যানরা রিকশা ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে। তখন কখনো ২০০ টাকা কখনো ৩০০ টাকা দিতে হয়। হাতিরঝিল সড়কে চলাচলরত ৪০টি রিকশার মালিক মানিক মিয়া। বাড্ডা এলাকায় তার দুটি রিকশা গ্যারেজ রয়েছে। বাড্ডায় ১২-১৩টি রিকশা গ্যারেজ রয়েছে। মানিক মিয়ার রিকশা গ্যারেজের ম্যানেজার বাছির মিয়া জানান, প্রতিদিন বাড্ডা ও হাতিরঝিল এলাকায় ৩০০ রিকশা চলাচল করে। সব রিকশাই অবৈধ। রিকশা আটক হলে চালকরাই ছাড়িয়ে আনে। জরিমানাও চালকদেরই দিতে হয়। তবে পুলিশ রিকশা থানায় নিয়ে গেলে মালিকদের ছাড়িয়ে আনতে হয়। কখনো কখনো আটক রিকশা আর ছাড়িয়ে আনা যায় না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একটি গ্যারেজের ম্যানেজার জানান, গ্যারেজটিতে ৬৬টি রিকশা রয়েছে। সবই ব্যাটারিচালিত। গভীর রাতে রিকশাগুলোয় বৈদ্যুতিক চার্জ দেওয়া হয়। ভোর ৪টার আগেই রিকশা জমা নেওয়া হয়। অনেক গ্যারেজে রিকশায় অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক চার্জ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে এলাকার প্রভাবশালী এবং সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ কর্মীদেরও ম্যানেজ করতে হয়। রিকশাচালকরা জানান, অবৈধ রিকশা আটক করলে জরিমানা তাদেরই গুনতে হয়। কিন্তু মালিকরা জমার ১ টাকাও কম নেয় না। যেদিন জরিমানা দিতে হয় সেদিন তাদের পানি খেয়ে থাকতে হয়। এক রিকশাচালক জরিমানা আদায়ের একটি রসিদ দেখিয়ে বলেন, ‘দেখেন আমাদের রক্ত ঝরা টাকা কারা নিচ্ছে।’ ডিসি ট্রাফিকের কার্যালয়-গুলশানা বিভাগ লেখা রসিদে ওই চালককে ৬০০ টাকা জরিমানা করা হয়। রসিদে লেখা- নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা। আদায়কারীর স্বাক্ষরে নাম রয়েছে- মাহফুজ। তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ইং। রেকার স্লিপ নং-১০১৭৭৭১। ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপারেশন) মনির হোসেন জানান, অবৈধ রিকশা বন্ধে অভিযান প্রতিনিয়ত চালানো হচ্ছে। জরিমানা ও রিকশা আটক করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশার ঝুঁকিও রয়েছে। দ্রুত চলা এসব রিকশা প্রায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। যাত্রীরাও আহত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অবৈধ রিকশা তৈরি করে যারা লাভবান হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিষয়গুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। চালকদের প্রতিও পুলিশেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) গবেষণা ফলাফল থেকে জানা যায়-ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ১১ লাখের ওপরে। দিনে একটি রিকশা দুই শিফটে চলায় চালকের সংখ্যা ২২ লাখের ওপরে।
সূত্র: যুগান্তর