শিরোনাম
আমনের মৌসুম শুরু হতে আরও কিছু দিন বাকি। এরপরই শুরু হবে ধানকাটা। সোনার ফসল ঘরে তুলবে কৃষক। ধান উঠবে বাজারে কিংবা ব্যবসায়ীর গুদামে। তবে মৌসুম শুরুর আগের সময়ে অনেকটা কর্মহীন, আয়-উপার্জনহীন দিন কাটছে মাঠের শ্রমিকদের। বিশেষত লোড-আনলোড কাজে নিয়োজিত কুলিরা এখন ধানকাটার মৌসুম শুরুর অপেক্ষায়। হাতে কাজ না থাকায় সংসারে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেকার সময়ে সংসারের খরচ মেটাতে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন সুতার জাল বোনার কাজ। সরেজমিনে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। সূত্র: জাগো নিউজ
কুলি নেতারা বলছেন, এ মুহূর্তে লোড-আনলোডের ব্যস্ততা না থাকায় তাদের অনেকেই জাল বোনার কাজকে আপদকালীন পেশা হিসেবে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া রাজধানীসহ দূরবর্তী বিভাগ থেকে বড় ব্যবসায়ীরা ট্রাক নিয়ে আসছেন না মফস্বলের আড়তগুলোতে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর ধানের মন্দা বাজারকেও কাজ না থাকার কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন তারা।
জেলার বিরামপুর উপজেলার লোড-অনলোড শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, উপজেলা শহরসহ বেশ কয়েকটি বাজারে রয়েছে শ্রমিকদের শাখা অফিস। এতে প্রায় ৫০০ শ্রমিক লোড-আনলোড কাজে নিয়োজিত। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তরাঞ্চলে ধানের আবাদ বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ শ্রমিক এ কাজের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ধানকাটার মৌসুম শুরু ও ধান বাজারে আসতে আরও কিছুদিন সময় লাগায় আপাতত তারা কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছেন।
গত বৃহস্পতিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে উপজেলার কাটলা বাজারের ধানহাটি এলাকায় দেখা হয় লোড-আনলোড কাজে নিয়োজিত পরিবহন কুলি আবুল কালামসহ এ পেশার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। সবাই দল বেঁধে বসে সুতা ভরা মাকু (সুতা বোনার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রবিশেষ) ও ফাতির কারিকুটিতে আপন মনে জালের গিঁট মারছিলেন। সাত-আটজন কুলি বেকার সময় সুতার জাল বুনছেন। কেউবা জাল বোনার ফাঁকে মোবাইল ফোনে পছন্দের গান শুনছেন। তাদের কারও কারও দৃষ্টি কখনো দূরের রাস্তায়, যে পথে আর কদিন পরই আসবে সারি সারি ট্রাক! সেসব ট্রাকে লোড-আনলোড হবে ধান, বাড়বে তাদের আয়-উপার্জন!
কুলিদের হাতেবোনা এ সুতার জালগুলো স্থানীয়রা নানা নামে চেনেন। কেউ বলেন তৈড়া, কেউ খেয়া জাল, কেউ কেউ মেছ বা সুতার জাল। নিপুণ হাতে বাহারি নামের এসব সুতার জাল তৈরির কর্মযজ্ঞেই এখন মশগুল কুলিরা।
তাদেরই একজন আবুল কালাম। এ সময়ে জাল বুনেই সংসার চলছে তার। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় ধান চাষ বেশি হয়। এখন ধান-চাল কেনাবেচা অনেকটাই কম, তাই সুতার জাল বুনে কিছু উপার্জন করছি।
তিনি বলেন, ধানের মৌসুম শুরু না হওয়ায় এখন সারাদিনে বাজারে দু-তিনটি ট্রাক আসে। সেগুলো লোড-আনলোড করে যে রোজগার হয় তাতে সংসার চালানো দায়। তাই সুতার জাল বিক্রি করে দু’বেলা খাবার জোগাড় করছি।
কুলি রফিকুল ইসলামেরও একই অবস্থা। বাজারে ট্রাক কম থাকায় জাল বুনে ও বিক্রি করে কোনোরকম টিকে থাকা। বর্তমানে কাজ না থাকায় জাল বুনে সময় পার করছি। শুধু সময় পার করছি তা নয়, কিছু রোজগারও হচ্ছে। প্রতিটি জাল বোনায় হাজার টাকার মতো খরচ হলেও সেই জাল বাজারে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। একটি জাল বুনতে প্রায় এক মাস সময় লাগে।
লোড-আনলোডের কাটলা হাট শাখার সদস্যরা জানান, ধানকাটা শুরু না হওয়ায় বাজারে মৌসুমি ব্যবসায়ী নেই, ট্রাক নেই, জীবিকার পথ অনেকটাই বন্ধ। সরকার সবাইকে প্রণোদনার আওতায় আনলেও তারা সেরকম কিছু পাননি। উপার্জন না থাকলেও পেটের ক্ষুধা, সংসারের ব্যয় থেমে নেই। দিন শেষে চাল-ডাল-নুন নিয়েই ঘরে ফিরতে হয়। পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে হয়। এ কারণেই তারা বিকল্প হিসেবে সুতার জাল বোনার কাজ বেছে নিয়েছেন।
জাল বোনায় ব্যস্ত রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার তিন সন্তান। বড় ছেলে রংপুর কারমাইকেল কলেজে আর মেজটা কাটলা হাইস্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র। ছোট ছেলে ভবানীপুর মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। কাজ না থাকায় পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। দূরের ব্যবসায়ীরা ট্রাক নিয়ে আসছে না। এখানে প্রায় ১৫ জনের মতো শ্রমিক কাজ করি। সারা দিনে দু-একটি ট্রাক লোড-আনলোড করে জনপ্রতি দেড়-দুশ টাকার বেশি পাই না, যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে না।
লোড-আনলোড কাটলা ইউনিয়ন শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম বলেন, প্রতি বছর এ সময়ে ব্যবসা মন্দা থাকায় কুলিরা অনেকটাই কর্মহীন হয়ে পড়ে। অনেক শ্রমিকের মাথার ওপর বিভিন্ন এনজিও ঋণের কিস্তি পরিশোধের বোঝাও। কিস্তির টাকা জোগাড় ও সংসারের খরচ মেটাতে তাদের অনেকেই জাল বোনার কাজে নামে। তাতে অন্তত কিছুটা রক্ষা হয়। চার-পাঁচজনে কাজের ফাঁকে সপ্তাহে একটি জাল বুনতে পারে।
কর্মহীন এ কুলিদের বিষয়ে জানতে চাইলে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিমল কুমার সরকার বলেন, করোনাকালীন সরকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের দুই হাজার ৫০০ টাকা করে প্রণোদনা দিয়েছে। অনেকে ত্রাণসহায়তাও পেয়েছে। কোনো শ্রমিক সুবিধাবঞ্চিত হলে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।