শিরোনাম
পাহাড়ের কোলঘেঁষা গ্রাম বগা। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার এ গ্রামটিতে আব্দুল কুদ্দুস নামে সাত ব্যক্তির বসবাস। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাঙ্খিত কুদ্দুসের (৪৮) সঙ্গে দেখা। সহজ-সরল মনের মানুষ। পেশায় ভ্যানচালক। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার চলে টেনেটুনে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আট মাস আগে। সূত্র: আরটিভি
মেয়ের কথা বলতেই প্রায় দুই মিনিট কথা বন্ধ। চোখের কোণে জমা জল গড়িয়ে পড়তে দিলেন না কুদ্দুস। কাঁধে থাকা গামছা দিয়ে চোখ মুছে জানালেন, অনেক ছোট বয়সে মা হারান তিনি। মায়ের আদর দিয়ে বড় বোন তাকে মানুষ করেছেন। বোনের চাওয়া, ভাইয়ের মেয়েকে ছেলের বউ করে ঘরে নিবেন। মায়ের আদর আর ভালোবাসা যে বোনের কাছে থেকে পেয়েছেন, সেই বোনের আবদার নাকি ফেলতে পারেননি তিনি। কম বয়সি মেয়ে, তাই বিয়ের রেজিস্ট্রি করা হয়নি। স্থানীয় মসজিদের ইমাম ডেকে বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ করেন। পুতুল খেলার বয়সের মেয়েটি স্বামীর সংসারে দুই মাসও টিকতে পারেনি। নানা জটিলতায় ফিরে এসেছে বাবার ঘরে। মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল! কুদ্দুসের চোখে ফের জল। এ জল অনুতপ্তের। স্বামীর ঘরে আর নয়, মেয়ে আবার যাবে স্কুলে। তার মতো এমন ভুল করতে মানা করলেন অন্যদের।
শুধু বগা গ্রামের কুদ্দুসের মেয়ে নয়, করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার প্রাথমিকের ১৬ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির ৩ জন ও পঞ্চম শ্রেণির ১৩ জনের বিয়ে হয়েছে।
বিয়ের পিঁড়িতে বসা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দারিদ্র্যতা, শিক্ষার অভাব, আত্মীয়-স্বজনসহ আশেপাশের মানুষের চাপেই বিয়েগুলো হয়েছে। একইসঙ্গে মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়েও কথা তোলেন তারা।
বাল্যবিয়ের শিকার সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা জানান, বিয়ে হলেও কেউ কেউ আবার স্কুলে আসছে।
নাম প্রকশে অনিচ্ছুক একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বিয়ের শিকার হয়েছে। তবে আগের তুলনায় বিয়ে দেয়ার হার অনেকটাই কমে এসেছে।
ঘাটাইল উপজেলায় স্কুল বন্ধকালীন সময়ে বাল্যবিয়ে বন্ধে কোনো কাউন্সেলিং লক্ষ্য করা যায়নি। তবে টাঙ্গাইল জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মেহেরুন্নেছা মনি বলেন, করোনাকালে এ বিষয়ে আমাদের শুধু ভার্চুয়াল সভা হয়েছে। উঠান বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা ছিল না। স্কুল-কলেজ খোলার পর আমরা জানতে পারলাম কি সর্বনাশ হয়ে গেছে! মাঠে গিয়ে আমরা নতুন করে আবার কাজ শুরু করছি। নবম-দশম শ্রেণির যে সকল শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে, এরই মধ্যে তারা অনেকেই গর্ভবতী হয়ে গেছে।
ঘাটাইলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বহু শিক্ষার্থী। এখানে মাধ্যমিক স্তরে স্কুল ও মাদরাসার সংখ্যা ৯২টি আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭২টি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৪৫ প্রতিষ্ঠান বাল্যবিয়ের তথ্য দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৩০ জন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে।
কিন্তু তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এক স্কুলেই বিয়ে হয়েছে ৫৫ জন ছাত্রীর। তবে ওই প্রতিষ্ঠান প্রধানের দাবি, সব ক্লাসের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ২০১৯ সালে এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল ঘাটাইলে বাল্যবিয়ের চিত্র। সেই সময় মাধ্যমিক স্তরে ৮ মাসে ৫০৬ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিল।
এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তাই বাল্যবিয়েরোধে কোনো কিছু করা যায়নি। স্কুল খোলার পর এসব বিষয় জানা যাচ্ছে।
ঘাটাইলের ইউএনও মো. সোহাগ হোসেন বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে অভিভাবকদের সচেতন করা হবে। যে মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে।