শিরোনাম
করোনা মহামারিতে গভীর সংকটে পড়েছে দেশের পর্যটন খাত। বন্ধ হয়েছে অসংখ্য ট্যুর ও ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠান। অনিশ্চয়তার দোলাচলে এই খাতসংশ্লিষ্ট প্রায় ৪০ লাখ জনশক্তি। এর মধ্যে চার লাখের বেশি চাকরি হারিয়েছেন। মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না অনেকে। যারা বছরের পর বছর ক্রমবর্ধমান এই খাতকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন, তাদের অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ আবার দিন গুনছেন সুসময়ের।
এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) লোকসান হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও নানা কারণে এখনো গতি পায়নি পর্যটন। পর্যটনশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তিন ধাপে ১৬ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এ অবস্থার মধ্য দিয়েই ২৭ সেপ্টেম্বর পালিত হবে বিশ্ব পর্যটন দিবস।
২০১৯ সালে ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে যেতে থাকে এই ভাইরাস। শুরু হয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হয়। ১৬ এপ্রিল পুরো দেশকে ‘সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে চলে সাধারণ ছুটি। বন্ধ করে দেওয়া হয় সব পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিনোদনকেন্দ্র, আকাশ, সড়ক, রেল ও নৌপথ। শুরু হয় পর্যটনের বিপর্যয়। এরপর দফায় দফায় বাড়তে থাকে লকডাউন। সংক্রমণ রোধে ঈদের সময়ও বন্ধ রাখা হয় পর্যটন এলাকা। কিছুদিন এভাবে টিকে থাকলেও একটা সময় মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন এ খাতসংশ্লিষ্টরা। হোটেল-রেস্তোরাঁসহ অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া বাকি সবাইকে ছাঁটাই করে। অথবা বেতনের জন্য ফের পর্যটন চালু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। এতে কর্মীদের পাশাপাশি তাদের ওপর নির্ভরশীল কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোয়েব-উর-রহমান বলেন, করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির পরও এ সংকট থেকে পর্যটনশিল্পের উত্তরণে সময় লাগবে। কারণ ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। তবে আশার দিক হলো, করোনার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, দেশের মানুষের মধ্যে ভ্রমণের প্রবণতা অনেক বেশি। ফলে পর্যটন ব্যবসা গতি ফিরে পাবে-এ কথা বলাই যায়। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) এক প্রতিবেদনে উঠে আসে পর্যটন খাতের ভয়াবহ চিত্র। এতে বলা হয়, ২০২০ সালে জিডিপিতে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়। ২০২০ সালে জিডিপিতে ৫৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা অবদান রেখেছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৮০ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে লোকসান ২৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। অর্থনীতিতে খাতটির অবদান হ্রাস পেয়েছে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ভ্রমণ ও পর্যটনশিল্পে ১৮ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। ২০২০ সালে তা কমে ১৪ লাখে দাঁড়িয়েছে। এ সময় কর্মসংস্থান কমেছে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। আর বিশ্বভ্রমণ ও পর্যটন খাতটি গত বছর প্রায় সাড়ে ৪ ট্রিলিয়ন বা সাড়ে ৪ লাখ কোটি ডলার লোকসান করেছে। বিশ্বে এই খাতের প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত ট্রাভেল এজেন্সি এবং পর্যটনসংশ্লিষ্ট খাতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা)-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, করোনায় ছয় মাসে বাংলাদেশের ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্প ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার টার্নওভার ঝুঁকিতে পরে। এই ক্ষতির এই বিবরণীর সঙ্গে দিনদিন যুক্ত হচ্ছে পর্যটনশিল্পের বিভিন্ন উপখাত। ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
জানতে চাইলে ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)-এর সভাপতি রাফিউজ্জামান বলেন, পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪০ লাখ লোক কাজ করেন। যারা দীর্ঘ সময় এই খাতকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। প্রতিবছর ৫ লাখের বেশি বিদেশি ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে আসেন। এখন ৭৮৫টি প্রতিষ্ঠান আমাদের এই সংগঠনের সদস্য। আমাদের পুরো প্রক্রিয়ায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে করোনায়। গত বছরেই আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এটা ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হবে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।
পর্যটনশিল্পের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সংকট উত্তরণের উপায় এবং ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক পর্যটন বাজারে সুবিধা অর্জনে ট্যুরিজম বোর্ড একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এতে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংকট ব্যবস্থাপনায় যেখানে ১৬টি পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে-পর্যটনশিল্পের উদ্যোক্তা, লোকবল ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা প্রদান; পর্যটনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তারল্য সহযোগিতা; পর্যটনশিল্প-সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি পর্যালোচনা এবং সহজীকরণ; পর্যটকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও আস্থা পুনরুদ্ধার; দক্ষতা উন্নয়নে কার্যক্রম গ্রহণ এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলোয় বাংলাদেশের পর্যটন অন্তর্ভুক্তকরণ।