শিরোনাম
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে শুরু করা আমরণ অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তবে আন্দোলনের অন্যান্য কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
অনশন শুরুর ১৬৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর গতকাল বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান।
আন্দোলনকারীদের পক্ষে দুপুরে শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম বলেন, তাঁদের দাবি মেনে নেওয়া হবে—এমন আশ্বাসের কথা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হককে জানানো হয়েছে। এ কথা জাফর ইকবাল তাঁদের জানিয়ে অনশন থেকে সরে আসার কথা বলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস রেখে অনশন কর্মসূচি থেকে সরে এসেছেন তাঁরা। তবে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে অন্যান্য কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
শিক্ষার্থীরা জানান, তাঁরা আন্দোলনের ধরন পাল্টাচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এত দিনের অবরোধ থেকে সরে আসছেন। গতকাল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তাঁরা। ইতিমধ্যে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বালু, বস্তা, রড দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক খুলে দেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলেন, উপাচার্য বিদায় না হওয়া পর্যন্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আলপনা আঁকা, মিছিলের মাধ্যমে আন্দোলন চলবে।
এর আগের দিন মঙ্গলবার দিবাগত রাত চারটার দিকে মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনশনস্থলে যান। সেখানে অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে জাফর ইকবালের আহ্বানে তাঁরা আমরণ অনশন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। অনশনকারীদের উদ্দেশে এ সময় জাফর ইকবালকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমরা জানো না, কত বড় আন্দোলন তোমরা করেছ। এখন সব বিশ্ববিদ্যালয় কাঁপছে।
তোমরা যেটা চেয়েছ, সেটা পাবে। এটা তোমাদের ক্যাম্পাস। তোমাদের আন্দোলনে ৩৪ জন ভাইস চ্যান্সেলরের ঘুম নেই।’ পরে তিনি কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে আন্দোলনের তহবিলে জমা দেওয়ার কথা বলেন। বলেন, ‘এবার পারলে সিআইডি আমাকে অ্যারেস্ট করুক।’
অধ্যাপক জাফর ইকবাল আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ৩৪ জন ভাইস চ্যান্সেলর বলেছেন, এখানকার ভাইস চ্যান্সেলর পদত্যাগ করলে তাঁরা পদত্যাগ করবেন। আমার খুবই শখ, এটা দেখার। যদিও আমার ধারণা, এ শখ মিটবে না।’
১৩ জানুয়ারি শাবিপ্রবির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। একপর্যায়ে ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। আন্দোলন চলাকালে পুলিশও শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পরে আন্দোলন উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।
গতকাল ছিল আন্দোলনের ১৪তম দিন। প্রথম কিছুদিনে দাবি পূরণ না হওয়ায় গত বুধবার বেলা তিনটা থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আমরণ অনশনে বসেছিলেন ২৪ শিক্ষার্থী। গত শনিবার রাত আটটা থেকে আমরণ অনশনের পাশাপাশি গণ-অনশনের নতুন কর্মসূচি শুরু হয়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল থেকে গতকাল সকালে অনশনস্থলে আনা হয় তাঁদের। একজন অনশনকারী গতকালও হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একাধিকবার শিক্ষার্থীদের অনশন প্রত্যাহার করে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলেও তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। একপর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ভার্চ্যুয়াল বৈঠক হয়। তবে কোনো ফলাফল আসেনি।
সরকার দাবি মানবে, আশা জাফর ইকবালের
শিক্ষার্থীদের দাবি সরকার মানবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। সরকারের উচ্চ মহলের অনুরোধে তিনি শাবিপ্রবিতে এসেছেন বলেও সাংবাদিকদের জানান।
জাফর ইকবাল জানান, সরকারের উচ্চ মহল কথা রাখবে, সেই আশা তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমি এসেছি মূলত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর জন্য। তারা আমাদের কথায় অনশন ভেঙেছে। আমি তাতে অত্যন্ত খুশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা (সরকারের উচ্চ মহলের প্রতিনিধি) আমার কাছে এসেছেন; আমি আপনাদের কাছে যাইনি। যেহেতু আপনারা অনুরোধ করেছেন; বলেছেন, “শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেব, আপনি গিয়ে এই ছেলেমেয়েদের অনশনের হাত থেকে রক্ষা করেন।’’ আমি সেই দায়িত্ব পালন করেছি।’
উপাচার্যের পদত্যাগ বিষয়ে সাংবাদিকেরা মুহম্মদ জাফর ইকবালকে প্রশ্ন করেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘তাঁরা (সরকারের উচ্চ মহলের প্রতিনিধি) যখন বলেছেন, দাবিদাওয়া মেনে নেবেন, এর মধ্যে কিন্তু এই দাবিটাও পড়েছে। সরকারের হয়তো টেকনিক্যাল ব্যাপার থাকে, রাজনৈতিক ব্যাপার থাকে, সেটার জন্য হয়তো তাদের একটা প্রসেস থাকে। গোপালগঞ্জের ভাইস চ্যান্সেলরকে তারা একভাবে সরিয়েছে, অন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে অন্যভাবে সরিয়েছে। কাজেই সেটা তাদের ব্যাপার।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম তুলে নেওয়াসহ নানা ‘অপচেষ্টার’ নিন্দা জানিয়েছেন জাফর ইকবাল। তাঁর ভাষায় এগুলো অমানবিক ও নিষ্ঠুর ছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তাকারী প্রাক্তন পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাঁদের (আন্দোলনরত শিক্ষার্থী) যাঁরা টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ মুহূর্তে তাঁরা হাজতে আছেন। সেখান থেকে কোর্টে চালান দেওয়া হবে। এর চেয়ে নিন্দনীয় ব্যাপার আর হতে পারে কি না, আমার জানা নাই। ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে, নাম ছাড়া। যখন প্রয়োজন হবে, সেখানে একজনের নাম ঢোকানো হবে। আমি আশা করছি, এই জিনিসগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা হবে।’
চলমান সংকটে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের অবনতির বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। যখন পুলিশের হামলা হয়েছে, তখন শিক্ষকদের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল, খবরদার, তোমরা এগুলো করতে পারবে না আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। একজন শিক্ষকও তা করেননি।’
শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান হবে: শিক্ষামন্ত্রী
বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা জানান, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে। তবে উপাচার্যের পদত্যাগ বা সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি ভিন্ন প্রক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিস্থিতি নিয়ে সন্ধ্যায় রাজধানীর হেয়ার রোডে সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
শিক্ষামন্ত্রী এ সময় বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে তাঁদের সমস্যাগুলো শুনে এর সমাধান করতে চান তিনি। শিক্ষার্থীদের মূল দাবি উপাচার্যের পদত্যাগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একজন উপাচার্য থাকলেন কি থাকলেন না, সেটি কিন্তু তাদের (শিক্ষার্থীদের) সমস্যা সমাধানে প্রভাব ফেলছে না। একজন উপাচার্য চলে গেলে আরেকজন উপাচার্য আসবেন। কিন্তু তাদের সমস্যা যদি থেকে গেল, তাহলে তো তাদের কোনো লাভ হলো না।’ তিনি বলেন, ‘উপাচার্যের ব্যাপারে অন্য নানা পদ্ধতি আছে। রাষ্ট্রপতি ও আচার্য এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। কাজেই এটা ভিন্ন প্রক্রিয়া।’
শিক্ষার্থীরা এখন আন্দোলনে ইতি টানবেন বলে আশা প্রকাশ করেন শিক্ষামন্ত্রী। বলেন, আন্দোলনের সময় যে মামলাগুলো হয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলবে না। মামলা তুলে নেওয়ার বিষয়ে তিনি কথা বলবেন।
প্রাক্তন পাঁচ শিক্ষার্থীর জামিন
শাবিপ্রবির প্রাক্তন পাঁচ শিক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর হয়েছে। সন্ধ্যায় সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২-এর বিচারক মো. সুমন ভূইয়া তাঁদের জামিন মঞ্জুরের আদেশ দেন। তাঁদের মধ্যে এ এফ এম নাজমুল সাকিব নামের একজনের করোনা শনাক্ত হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জামিনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী কানন আলম।
তথ্য ও ভিডিও চায় তদন্ত কমিটি
১৬ জানুয়ারি শাবিপ্রবিতে পুলিশের হামলার ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। গতকাল স্থানীয় দৈনিকে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও স্কুল অব ফিজিক্যাল সায়েন্সেসের ডিন মো. রাশেদ তালুকদার ঘটনার তথ্য ও ভিডিও ক্লিপ চেয়েছেন। এর আগে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ঘটনার পরদিন তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।
গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে স্কুল অব ফিজিক্যাল সায়েন্সেসের ডিনের কার্যালয়ের সামনে রক্ষিত বাক্সে যে কেউ তথ্য ও ভিডিও ক্লিপ জমা দিতে পারবেন। এ ছাড়া [email protected] ই–মেইলে তথ্য পাঠানো যাবে। ডাকযোগেও তথ্য পাঠানো যাবে। ব্যক্তিগতভাবে শুনানিতে অংশগ্রহণ করেও তথ্য জানাতে পারবেন আগ্রহীরা। তথ্য প্রদানকারীদের নাম–ঠিকানা, পরিচয় গোপন রাখা হবে।
সংহতি জানিয়ে শাহবাগ ও চবিতে কর্মসূচি
প্রতিবেদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানান, শাবিপ্রবি উপাচার্যকে ‘স্বৈরাচারী উপাচার্য’ আখ্যা দিয়ে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো। দুপুরে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এটি শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জানান, শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দুপুরে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। এদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকে অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যা দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শাবিপ্রবিতে চলমান সমস্যা সমাধানে সব পক্ষের আলোচনায় বসা জরুরি।
সূত্র: প্রথম আলো