শিরোনাম
বছরজুড়ে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখেছে বাংলাদেশ। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কৃষিখাত। তবে খাদ্য উৎপাদনে কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে। তারপরও যোগানে পড়েছে টান। এতে হু হু করে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। চালের দাম পৌঁছেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা যে তথ্য দিয়েছেন তাতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে গরমিল। রেকর্ড উৎপাদনের পরও বছরের পুরো সময়জুড়ে খাদ্যপণ্যের বাজারে গিয়ে নাকানি-চুবানি খেয়েছে সাধারণ মানুষ।
পরিবারের খাবার যোগাতে বেশি ভুগেছে দরিদ্ররা। স্বল্পমূল্যে খাবারের জন্য হাহাকার ছিল অধিকাংশ সময়। ন্যায্যমূল্যে খাদ্য পেতে মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরেছে টিসিবির ট্রাকের সামনে।
সরকারের তথ্য বলছে, এ বছর বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি টনের বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সময়ে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন, গম ১২ লাখ টন, ভুট্টা প্রায় ৫৭ লাখ টন, আলু ১ কোটি ৬ লাখ টন, শাকসবজি ১ কোটি ৯৭ লাখ টন, পেঁয়াজ ৩৩ লাখ টন, তেল জাতীয় ফসল ১২ লাখ টন ও ডালজাতীয় ফসল ৯ লাখ টন।
এর মধ্যে সবগুলো খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিগত বছরের তুলনায় বেশি। সবমিলে দেশের এ বছর মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন দাঁড়িয়েছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ টনে। উৎপাদন বেড়েছে সার্বিকভাবে গড়ে ৩ শতাংশ হারে। এমনকী আলু, মাছ, মাংস ও ডিমের উৎপাদনও ছিল উদ্বৃত্ত। তারপরও সারা বছর ক্রমাগত বেড়েছে পণ্যের দাম।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ পর্যন্ত। পাশাপাশি আটা ও ময়দার ২৪ থেকে ৩৬ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম ৪৯ শতাংশ, পামের ৫০ শতাংশ, ডাল ২৭ শতাংশ এবং পেঁয়াজের দাম ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
টিসিবি বছরব্যাপী বেশকিছু খাদ্যপণ্যের দামের হিসাব রাখে। বছর শেষে সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, প্রায় ৩৪ ধরনের খাদ্যপণ্যের মধ্যে বছরের ব্যবধানে দাম কমেছে মাত্র ৮টির। বেড়েছে বাকি সবগুলোরই। দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে অধিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো। কমার তালিকায় সেসব পণ্য রয়েছে যেগুলো তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয়। যেমন লবঙ্গ, এলাচ, তেজপাতা।
ফলে ২০২১ সালের সারা বছরজুড়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতায় কেটেছে দেশ। এতে করোনায় বিপর্যস্ত মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ বছরেই অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। আবার চাকরি থাকলেও বেতন কমেছে অনেকের। ভালো ছিলেন না ব্যবসায়ীরাও।
আবার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যেসব পণ্যের মূল্য ওঠানামা করে সেগুলোর পরিস্থিতিও খারাপ হয়েছে বহুগুণ। এতে ভোগান্তি হয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান কৃষিখাত। দীর্ঘসময় ধরেই এ খাত ভালো করছে। তারপরও উৎপাদনের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না কিছু জায়গায় অব্যবস্থাপনার কারণে। অনেক সময় সে সাফল্য পুরোটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে যখন নিত্যপণ্যের যোগান আর দৃশ্যমান থাকছে না।
অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কয়েক দফায় বেশ কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। সে বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী পণ্য বিক্রি নিশ্চিত করতে মাঝে মধ্যে মাঠেও নেমেছে সরকারের অধীনে দর-মান নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। কিন্তু বাস্তবে সুফল পাননি সাধারণ মানুষ। নিয়ন্ত্রকের চোখের আড়ালে চড়া দামেই কিনে খেতে হয়েছে খাবার।
পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরেও কেন খাদ্যপণ্যের যোগান নেই- এমন প্রশ্ন যখনই এসেছে তখনই উঠেছে তথ্য বিভ্রাটের কথা। কোনো পণ্যের যোগানে ঘাটতি দেখা দিলেই দেখা গেছে ওই খাদ্যশস্যের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যা আছে, তার মধ্যেও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা, বড় ফারাক। একেক সংস্থার পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে একেক তথ্য। তাতে কর্মপরিকল্পনার সিদ্ধান্তে দুর্বলতা দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে ভুল পরিকল্পনাও হয়েছে।
এ বছর যখন চালের দাম বাড়তে শুরু করে ওই সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাল উৎপাদনের তথ্য নিয়ে এ পণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধান্বিত হয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সঠিক পরিকল্পনা করতে পারেনি তারা। ফলে চালের বাজারে বড় প্রভাব পড়েছে- এমন কথা খোদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের বক্তব্যেও উঠে এসেছে কয়েক দফা।
আবার তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকেও তথ্য বিভ্রাটের বিষয়টি সামনে আসে। তখন এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঠিক চাহিদা ও দেশীয় উৎপাদন নির্ধারণ সম্ভব হয়নি। ফলে ধারণানির্ভর তথ্যের ওপর নেওয়া হয়েছে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ওই সময়ও খাদ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো পণ্যের সঠিক তথ্য নেই। উৎপাদনের সঠিক তথ্য না থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়।’
এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান প্রশ্ন তুলে বলেন, এসব উৎপাদনের সাফল্য দেখানোর জন্য বাড়িয়ে তথ্য দেওয়া হয়। দেশে খাদ্য সংক্রান্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত রয়েছে তাতে গরমিল আছে। এজন্য দেশের একেক মন্ত্রী একেক কথা বলেন। একেকজনের দপ্তরের তথ্য একেক রকম। এজন্য চাহিদা, যোগান ও বাস্তবতা কিছুই মেলে না। সবকিছু গোলমেলে হয়।
আরও যা যা হলো
বছরের শুরুতেই সরকারের চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। শুরুর দিকে সরকারের গুদামে চালের মজুত ছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার টন (৭ ফেব্রুয়ারি)। ওই পরিস্থিতিতেই মূলত দেশ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়ে। কারণ ন্যূনতম ৮ লাখ টন চালের মজুতকে সরকারের স্থিতিশীল মজুত বলে বিবেচনা করা হয়।
এরপর থেকে ঘাটতি পূরণে দফায় দফায় চাল আমদানি করা হয়। ফলে বছর শেষে চাল আমদানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে বাংলাদেশ। যা ক্রমাগত উৎপাদনের তথ্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) চলতি মাসের ‘খাদ্যশস্য: বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দ্বিতীয় আমদানিকারকের এ হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২০-২০২১ বাণিজ্য বছরে বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে। যদিও এ তথ্য সঠিক নয় বলে সম্প্রতি দাবি করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
অন্যদিকে বছরজুড়ে এবার নানামুখী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, নানামুখী কৌশলে রোগবালাই দমন, কৃত্রিম উপায়ে শাক-সবজি চাষ, ছাদকৃষির প্রসার ছিল আলোচনার বিষয়। কৃষিক্ষেত্রে এ বছর নানা ধরনের উদ্ভাবন ও নতুন জাত তৈরি করেছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। অনেক উদ্ভাবনের মধ্যে শেষ এ মাসে দেশে প্রথমবারের মতো লবণ ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করে সাড়া ফেলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) একদল গবেষক।
আবার এ বছর করোনা মহামারির মধ্যেই এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলকে পৌঁছে যায় কৃষিপণ্য। শেষ (২০২০-২১) অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের হিস্যা ছিল বেশি।
এরপর এ রপ্তানি আয় তিন বছরের মধ্যে দুই বিলিয়নে নিতে একটি রোডম্যাপ করেছে সরকার।
অন্যদিকে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে গতবছর নেওয়া রোডম্যাপের সুফল মিলেছে এ বছর। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৬ লাখ টন বেড়েছে। দামও সহনশীল।
সূত্র: জাগো নিউজ