শিরোনাম
পদ্মায় ধরা পড়ল ৬৬ কেজি ওজনের ৩টি মাছ, এক মাছের দাম ২৭ হাজার টাকা, বরগুনায় ধরা পড়ল ২৫ কেজির মাছ, ৪ মাছ বিক্রি হলো ৭৩ হাজার টাকায়। বাজারে আসতে না আসতেই বিক্রি হয়ে গেল মাছটি। মেঘনায় জেলেদের জালে ধরা পরছে ঝাঁকে ঝাঁকে ৭ টি মাছ ধরে একদিনেই লাখপতি।
উপরের সব ক’টি লাইন সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধম্যে প্রকাশিত একটি মাছকে নিয়ে। যে মাছ নিয়ে এত মাতামাতি তার নাম পাঙ্গাস। এক সময় বাংলাদেশের নদ-নদীতে অনেক পাঙ্গাস মাছ পাওয়া গেলেও বিগত কয়েক বছরে তা যেন প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল।
বিগত কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীতে বড় বড় পাঙ্গাস মাছ ধরা পড়ছে। পদ্মা নদীর রাজবাড়ী, রাজশাহী ও শরিয়তপুর অংশে শুধু একটা দুটো নয় ঝাঁকে ঝাঁকে পাঙ্গাস মাছ ধরা পড়ছে। এ ছাড়াও তেঁতুলিয়া, বিশখালী, আন্ধারমানিক, মেঘনা, পদ্মা নদীতেও পাঙ্গাস ধরা পড়ছে।
দু’ চারটা পাঙ্গাস প্রাপ্তি জেলেদের জন্য যেন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। ভাগ্য অনুক‚লে থাকলে একদিনে কোন কোন জেলে আট দশটা বড় বড় পাঙ্গাস ধরে লক্ষাধিক টাকা আয় করার সুযোগ পাচ্ছে ।
কথা হয় শরীয়পুরের নড়িয়া উপজেলার হাইলসার গ্রামের মৎস্যজীবী হানিফের সাথে। তিনি জানান গত বছর ৮ নভেম্বর এক রাতে তার জালে ৮৬ টি পাঙ্গাস ধরা পড়ে।
তিনি সে সব মাছ স্থানীয় আড়তে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিক্রি করেন। ৩০ বছর বয়েসি হানিফ বলেন তিনি ছোট বেলা থেকে মাছ ধরছেন তবে এ বছরের মত এত পাঙ্গাস মাছ তিনি কখনই ধরা পড়তে দেখেননি।
হানিফের মত অনেক জেলে এখন পাঙ্গাস ধরে ভাগ্য ফেরাতে দিন গুনছেন । শরীয়পুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর পয়েন্টের পদ্মা নদীর অংশে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে পাঙ্গাস। বিগত বছরের তুলনায় এই বছর নদীতে পাঙ্গাসের সংখ্যা অনেক বেশি। ধরা পরা পাঙ্গাস গুলোর ওজন গড়ে ৩ থেকে ১৫ কেজি পর্যন্ত। অনেক জেলে এক দিনে প্রায় ৫০-৬০ টি পর্যন্ত পাঙ্গাস মাছ ধরতে পেরেছে।
গত শুক্রবার সকালে সুরেশ্বর মৎস্য আড়তে গিয়ে দেখা গেছে, সারিবদ্ধ ভাবে পাঙ্গাস রেখে দিয়েছে জেলেরা। পরে সেই মাছ গুলো আড়তের মালিকরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। এছাড়াও দাম তুলনামূলক ভাবে কম হওয়ায় দূর দুরান্ত হতে অনেক ক্রেতাও পাঙ্গাস মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বেশি মাছ ভাল দামে বিক্রি করতে পেরে জেলেরা দারুন খুশি।
ঐ গ্রামের আরেক মৎস্যজীবী দাদন সর্দার জানান, মা ইলিশ ও জাটকার মত আমরা যদি পাঙ্গাস সংরক্ষণের দিকে নজর দেই তা হলে ভবিষ্যতে পাঙ্গাস উৎপাদন আরো বাড়বে।
কেন হারিয়ে যাচ্ছিল পাঙ্গাস-
মৎস্য আইন অনুসারে ১২ ইঞ্চির নীচে (৩০ সেন্টিমিটার) পাঙ্গাস ধরা নিষিদ্ধ। আর তেঁতুলিয়া, বিশখালী, আন্ধারমানিক, মেঘনা ও পদ্মা মেঘনার সংযোগস্থল দেশীয় পাঙ্গাস পোনার অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্র। বাঁশের তৈরি চাঁইয়ের মাধম্যে মূলত নির্বিচারে পাঙ্গাসের পোনা ধরার কারণেই এ মাছটি হারিয়ে যেতে বসেছিল। কেননা পদ্মা ও মেঘনা নদীতে জেলেরা বড় বড় চাঁই পেতে একধরনের খাবার দিত যাতে লক্ষাধিক পাঙ্গাসের পোনা ধরা পড়তো। তা ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও সার ব্যবহার, কল কারখানার দূষিত বর্জ্য নদী ও সাগরে ফেলা, প্ল্যাস্টিক দূষণের কারণেও দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছিল জনপ্রিয় মাছ পাঙ্গাস।
নদী-নালা দখল, জলাশয় ধ্বংস, দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন, কারেন্ট জাল ব্যবহার এবং জলাভ‚মি তথা নদ-নদী, জলাশয়ের ওপর অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও পাঙ্গাস সহ দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। সুরেশ্বর মাছঘাটের আড়তদার সুমন বকাউল বলেন, “নদীর পাঙ্গাস বৃদ্ধি হলে আমরাই উপকৃত হব কিন্তু কে শুনে কার কথা, যে করেই হোক অবৈধ ভাবে পাঙ্গাস ধরা বন্ধ করতে হবে”।
চাঁদপুর সদরের পুরান বাজারের মৎস্যজীবি নেতা তসলিম উদ্দিন বলেন, “চাঁদপুরের মোহনা ও সুরেশ্বর পয়েন্টে যে পরিমানে পাঙাসের পোনা অবৈধ ভাবে ধরা হয় সে সব যদি রক্ষা করা যেত তাহলে এ অঞ্চলকে আমরা ইলিশের পাশাপাশি আর একটা পাঙাসের খনিতে রূপান্তরিত করতে পারতাম”
আবার কেন দেখা দিচ্ছে পাঙ্গাস
বিগত কয়েকবছর ধরে ইলিশের ফলন বেড়েছে। সঠিকভাবে জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ সহ সরকারের নেয়া নানারকম কর্মসূচির ফলে এটি বাড়ার সুযোগ পেয়েছে। ইলিশ রক্ষা কর্মসূচির প্রভাবে নদীতে অন্যান্য মাছও বেড়েছে। তবে এক্ষেত্রে ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ প্রকল্পের বেশ ভ‚মিকা রয়েছে। এ প্রকল্পের পক্ষ থেকে পাঙ্গাস মাছ রক্ষার জন্য নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে।
মৎস্য অধিদপ্তর ও ইকোফিশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চাঁদপুর, শরীয়তপুর এর পদ্মা-মেঘনার সংযোগস্থলসহ পাঙ্গাসের বিভিন্ন প্রজননস্থলের স্থাপিত অবৈধ চাঁই উচ্ছেদ হয়েছে। ইকোফিশের লিফলেট ও পোস্টারের তথ্য জেলেদের পাঙ্গাস রক্ষায় অনুপ্রাণিত এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ইকোফিশ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জেলেদের জন্য যে সহ-ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি চালু করেছে।
২০১৫ সাল থেকে ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশসহ বড় মাছের প্রজননক্ষেত্রগুলো রক্ষা ও পোনা নিধনের কুফল সম্পর্কে জেলেদের যেভাবে সচেতন করা হয়েছে সে সবের সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি।
পুষ্টিগুণে অনন্য পাঙ্গাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি গবেষকেরা দেখেছেন, পাঙাশ মাছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড অনেক বেশি। এ কারণে পাঙাশে থাকা আমিষের মান উন্নত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা বলছেন, শস্যদানা, ফল বা সবজির চেয়ে উচ্চমানের আমিষ বেশি আছে মাছে। তাঁরা বলছেন, পাঙাসে ও উচ্চমানের আমিষ আছে।
তাছাড়া সু স্বাদু ও কাঁটা না থাকায় সব বয়েসীদের কাছে এ মাছের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। পাঙ্গাস দ্রুত বর্ধনশীল ক্যাটফিশ প্রজাতির মাছের একটি যা সর্বোচ্চ ৬০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। গত বছরে ১১ হাজার মেট্রিক টন পাঙ্গাস পাওয়া গিয়েছে।
পাঙ্গাস রক্ষায় আরো যা যা রক্ষায় করণীয়ঃ
পুষ্টির উৎস ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যও পাঙ্গাস মাছের গুরুত্ব অপরিসীম৷ পাঙ্গাস রক্ষায় জরুরী ভিত্তিতে যে সব পদক্ষেপ নিতে হবে
-কৃষিকাজে পরিমিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে পাশাপাশি পোকামাকড় দমনের জন্য জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
-উন্মুক্ত জলাশয় যেমন বিল, হাওর, নদী, খাল যেগুলো সরকারি সম্পত্তিগুলোকে কোন ব্যক্তি বিশেষকে বা নামমাত্র কোন সংগঠনকে লিজ বা বন্দোবস্ত না দিয়ে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের কাছে লিজ দিতে হবে।
-নদী-নালা বা জলাশয়ের ওপর কোন অবকাঠামো নির্মাণের আগে সেটি পরিবেশ বা নদী-নালার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে কি না তা যাচাই করে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণ।
-মাছের পোনা নিধন এবং ডিমওয়ালা মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অন্য কেউ পোণা নিধন বা ডিমওয়ালা মাছ শিকার করতে সাহস পাবে না।
-ভরাট নদীনালা, ডোবা, জলাশয় পুনঃখনন করে দেশের সব নদ-নদীতে মাছের অভয়াশ্রম কিংবা প্রতিটি জেলা বা উপজেলায় নিদির্ষ্ট কোন জলাশয়কে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা।
-সরকার ইলিশ রক্ষায় যেভাবে অভয়াশ্রম ঘোষণা ও প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় একইভাবে অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে।
-সরকার ঘোষিত মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে প্রণোদনা বাড়ানো, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সহ তাদের জীবন মান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।
-দেশি মাছ রক্ষায় যুগোপযোগী আইন করতে প্রণয়ন ও কঠোর ভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
-দেশি মাছের উন্নয়ন ও সংরক্ষণের আরো বেশি গবেষণার উদ্যোগ নিতে হবে
-এ ছাড়াও ইলিশের মত পাঙ্গাস মাছের ভাণ্ডার ও প্রজননস্থলসমূহ কে আলাদা ব্যবস্থাপনায় আওতায় এনে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।