কাচের ভবন বাড়াচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা!

ফানাম নিউজ
  ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:২৮

আধুনিককালের অবকাঠামো নির্মাণশৈলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে কাচ (থাই গ্লাস বা আর্কিটেকচারাল গ্লাস)। বসত-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা শিল্প-কারখানা— সর্বত্রই কাচ ব্যবহারের ছড়াছড়ি। সৌন্দর্যের দিকটা তো রয়েছেই, আছে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারও। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নতুন যেসব বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে, সেসবের অধিকাংশেরই বহিরাবরণে কাচ ব্যবহার করা হচ্ছে।

বাণিজ্যিক ভবনের বহিরাবরণে কাচের ব্যবহার নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে এলেও এর পরিবেশগত ঝুঁকি ভাবাচ্ছে পরিবেশবিদদের। কাচে (গ্লাস) সূর্যের আলো প্রতিফলিত হওয়ায় এ ধরনের ভবনের চারপাশে বেশি মাত্রায় তাপ উদ্গীরণ হয়। আবার ভবনের তাপমাত্রা ঠান্ডা রাখতে সারাবছর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, যা গ্রিন হাউজের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নান্দনিকতার জন্য কাচের ব্যবহারে বড় মাশুল দিতে হবে। গ্রিন হাউজের প্রভাবে বাড়বে রোগবালাই।

ভবন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীর ধুলা-ময়লা আর শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে তারা ভবনে কংক্রিটের দেয়ালের পরিবর্তে কাচ ব্যবহার করেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ ও কমার্শিয়াল ভ্যালু বাড়াতে কাচের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা।

রাজধানীতে এ ধরনের কতগুলো ভবন আছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, ইন্টেরিয়র, এক্সটেরিয়র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত বাণিজ্যিক ভবনেই কাচের চাহিদা বেশি।

ইন্টেরিয়র প্রতিষ্ঠান ডিজাইন কোড স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী আদুল্লাহ আল মিরাজ বলেন, চার-পাঁচ বছর ধরে ভবনের বাইরে কাচের ব্যবহার বেড়েছে। নান্দনিক সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার- এসব কারণে ভবন মালিকরা কংক্রিটের দেয়ালের পরিবর্তে কাচ ব্যবহার করতে চান।

তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ভবনে কংক্রিটের চেয়ে কাচের ব্যবহার করতে আগ্রহী মালিকরা। ভবনে সহজেই সূর্যের আলো পাওয়া যায়, বাইরের সৌন্দর্যটাও দৃষ্টিনন্দন হচ্ছে। কাচের একটা আলাদা কমার্শিয়াল ভ্যালু তৈরি হয়েছে। এই কাচ আসলে আবাসিক ভবন ও বাণিজ্যিক ভবনের মধ্যে পার্থক্য করে দেয়। কাচ ব্যবহারে ভবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এর চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখন বলা যায় বাণিজ্যিক ভবন মানেই কাচ দিয়ে ঘেরা। বড় কোম্পানিগুলো তো আছেই, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোট কোম্পানিগুলো অফিসে কাচের আবরণ করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামো নির্মাণশৈলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে আর্কিটেকচারাল গ্লাস। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা শিল্প-কারখানার অফিসে ব্যবহার হচ্ছে কাচ।

স্যাম প্রপার্টিজের ম্যানেজার সাদ মুহাম্মদ বলেন, সৌন্দর্যের দিকটা তো আছেই, সেই সঙ্গে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারও আছে। কাচ ব্যবহারের কারণে ভবনে সূর্যের আলো পাওয়া যাচ্ছে।

তবে এক্ষেত্রে পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে আমরা ভবন বানিয়ে দেই।

কোড স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী আদুল্লাহ আল মিরাজ বলেন, শহরে নতুন যেসব বাড়িঘর বা অফিস ভবন গড়ে উঠেছে, সবগুলোতেই কাচের ব্যবহার হচ্ছে। ভবনের বহিরাবরণে কংক্রিটের জায়গা নিয়েছে কাচ। আবার অনেক অফিসে পার্টিশনে কাচ ব্যবহার করছে। মিটিং রুম বা অফিসার রুম আলাদা করছে এই কাচ। তবে পরিবেশের কথা বিবেচনা করে আমরা অনেক সময়ই কাচ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে চাই।

জানা গেছে, এনিলিড গ্লাস, হিট স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, কেমিক্যালি স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, হিটেবল গ্লাস, ইনসুলেটিং গ্লাস, টাফেন্ড গ্লাস দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে এসব ভবন। এমনকি ভূমিকম্পের কম্পন এবং উচ্চমাত্রা কম্পনবিশিষ্ট শব্দতরঙ্গ সহনশীল সাইজমিক গ্লাস দিয়েও ভবন তৈরি হচ্ছে আজকাল।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিলুর রহমান খান বলেন, কাচের ভবনের মূল সমস্যা হচ্ছে এটা প্রচুর তাপ শোষণ করে। আরবান হিট বাড়াচ্ছে এই কাচের ভবন। যেসব দেশে কাচের ব্যবহার বেশি- সেগুলো আসলে শীতের দেশ। আমাদের দেশে ব্যাপারটা এমন নয়। বাইরের দেশ থেকে এটা আমরা কপি করছি। এটা আমাদের পরিবেশের জন্য ভালো নয়। ঢাকাসহ অনেক জায়গায় তাপমাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে, অনেক রোগবালাইও বাড়ছে। আমরা যদি তাপ না কমাতে পারি তাহলে তা জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলবে। এজন্য পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ইমারত বিধিমালায় উদ্যোগ নিতে হবে।

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, বহুতল ভবনে ওজন কমানোর জন্য কংক্রিটের দেয়ালের পরিবর্তে কাচের ব্যবহার বাড়ছে। এটা ভবন নির্মাণের খরচও কিছুটা কমাচ্ছে। বর্তমানে অনেক দেশেই এভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সাধারণত ভবনে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ব্যবহারে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কাচের ভবনে সহজেই প্রাকৃতিক আলো পাওয়া গেলেও ভেন্টিলেশন না থাকায় বাতাস চলাচলে সমস্যা হয়।

তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ভবনে এখন উন্নত বিশ্বের আদলে কাচ ব্যবহার করা হচ্ছে। এটার সুবিধা হলো কম খরচে নির্মাণ করা যায়। আর অসুবিধা হলো সূর্যের তাপ বেশি শোষণ করায় এসি ব্যবহার করতে হয়। এয়ার ভেন্টিলেশন না থাকায় সারাক্ষণ এসি ব্যবহার করতে হয়। এসি ব্যবহারে গ্রিন হাউজে প্রভাব পড়ে। এটাকে আসলে নিরুৎসাহিত করা উচিত বলে আমি মনে করি।

কাচের ভবন রাজধানীর তাপমাত্রা বাড়ার অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল- এই ২০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া চট্টগ্রামে বেড়েছে ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি, খুলনায় ১ দশমিক ২৭, সিলেটে ১ দশমিক ১, রাজশাহীতে বেড়েছে সবচেয়ে কম শূন্য দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। হিট স্ট্রোক, ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগও তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ভবন নির্মাণে কাচের ব্যবহার কমানো গেলে তা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে প্রভাব রাখবে বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) শরীফ জামিল বলেন, কাচের ভবনগুলোতে এসি লাগাতে হয়। এসি ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করে, আর গ্যাস ছাড়ে। এটা ওজনস্তরের ক্ষয়ের জন্য দায়ী। সিএফসি, এইচএফসি গ্যাস বাড়ায় নগরের তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। কাচের ভবনের অনেক খারাপ প্রভাব আছে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের ইমারত বিধিমালায় এ বিষয়ে কিছু বলা নেই। আবার নতুন ড্যাপে (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায়) এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ আছে বলে জানা নেই। ভবন কে কীভাবে নির্মাণ করবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় কাচের ব্যবহার আসলে বাড়ছে। ইমারত বিধিমালা সংশোধন করে কংক্রিটের দেয়ালের পরিবর্তে কাচের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সূত্র: জাগো নিউজ