শিরোনাম
গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে বহু স্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানির প্রতারণা। এই পদ্ধতির ব্যবসায় ডেসটিনি, যুবক ও ইউনিপেটুইউসহ আরও নানা নামে এমএলএম কোম্পানি খুলে সাধারণ মানুষকে লাখোপতি ও কোটিপতি হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
যার একটা বড় অংশ পাচার হয়েছে বিদেশে। গত কয়েক বছরে ই-কমার্স ব্যবসার নামেও চটকদার ছাড়ের প্রলোভন দিয়ে পণ্য বিক্রির নামে অন্তত ১৫ কোম্পানি হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে কয়েকটি কোম্পানির মালিক বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে পালিয়েছে। প্রতারণার ধরন পাল্টে বিভিন্ন সমবায় সমিতিও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করেছে। চলতি বছরের গত ছয় মাস ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখাসহ (সিআইসি) বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে নজরদারি করে তথ্য-প্রমাণসহ এমন ৫৪ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ৬০ লাখের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বয়সে তরুণরা এসব প্রতারণায় বেশি জড়িত। তাদের অনেকেই ডেসটিনি ও যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানে আগে কাজ করেছেন। সূত্র: জনকণ্ঠ
জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের টাকা লুটের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড, যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক ও ইউনিপেটুইউ। এরমধ্যে ডেসটিনির মালিক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ৯৬ কোটি টাকা পাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে তিন লাখ চার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক। এই প্রতিষ্ঠানেরও বড় একটি অংশ পাচার হয়ে গেছে। ২০১১ সালের কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ইউনিপেটুইউতে ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের আশায় ৬ লাখ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করা ৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে ২০১৩ সালে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় আইসিএল গ্রুপ। পরবর্তীকালে নামসর্বস্ব ১৩টি প্রতিষ্ঠান ফেলে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে পালিয়ে যায় গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মূল উদ্যোক্তারা। গত এক মাসে অন্তত ১০টি অনলাইন এমএলএম কোম্পানি বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের কয়েকশ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইনসাফ সেভেন, টু-লাইক, গোল্ডরাশ, গোল্ড লাইন, বিন্দাসওয়ার্ক ডটকম, বিডি লাইক, ইফোর্ডবিডি, জিওনেস, লাইক এইচএমপি ওয়ার্ল্ড, টু-লাইক ওয়েব, বিডি ক্যাশ রিওয়ার্ডস, স্টারস ফেয়ার২৫.কম, ওয়ালমার্ট গ্রæপ, জিএসসিবিডি, ইউকে লাইকসহ অনেক কোম্পানি। এছাড়া ২০০৮ সাল থেকে ওই বছর পর্যন্ত ২৬৬টি সমবায় সমিতি প্রায় ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। যার অধিকাংশই পাচার হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এরমধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান রাগীব আহসানকে গ্রেফতার করে র্যাব। এহসান গ্রুপ গ্রাহক ও সমিতির সদস্যদের বড় অঙ্কের মুনাফা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ১১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
এদিকে চটকদার সব পণ্যের অফার দিয়ে আলোচনায় আসা ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল প্রায় শত কোটি টাকা কয়েকটি দেশে পাচার করেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে। টাকা পাচারের বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাসেল ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ১১ বার বিদেশে গেছেন। বিদেশে যাওয়ার তার মূল উদ্দেশ্য ছিল যে, ইভ্যালিকে অন্য দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পরিচিত করানো। যাতে তারা সহজেই তাকে পণ্য সরবরাহ করে। বিদেশের একাধিক প্রকল্পে তার বিনিয়োগ রয়েছে। তার এ কাজে সহযোগিতা করেছে তার এক বন্ধু। তিনি চীন থেকে মোবাইল ফোন এনে থাকেন। বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ওই বন্ধুর হাত রয়েছে বলে রাসেলকে রিমান্ডে নিয়ে জানতে পেরেছে পুলিশ। এছাড়া ই-কমার্সের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতে অন্তত ১৬৪ কোটি টাকা গায়েব করে লাপাত্তা আরও তিন রাঘববোয়াল। এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেড, সিরাজগঞ্জশপ ডটকম ও ধামাকা নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিসহ একাধিক সংস্থা ছায়া তদন্ত শুরুর আগে এর কর্ণধাররা গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ দেশের বাইরেও পালিয়ে গেছেন। এরই মধ্যে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ১১৬ কোটি টাকা পাচার করেছে ধামাকা। এসিপিসি ওয়ার্ল্ড ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা পাচার করেছে। আর সিরাজগঞ্জশপ ডটকম হাতিয়ে নিয়েছে ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা। ধামাকার প্রধান জসিম উদ্দিন চিশতি, সিরাজগঞ্জশপের মালিক ও প্রধান নির্বাহী জুয়েল রানা এবং এসপিসি ওয়ার্ল্ডের মোঃ আলামিনকে আইনের আওতায় আনতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের মধ্যে গত জুলাই মাসে চিশতি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। আর জুয়েল ও আলামিন দেশেই পলাতক আছে। এর আগে ই-অরেঞ্জের অন্যতম পরিচালক পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা প্রায় ১১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশের বাইরে পালাতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন। এদিকে সিআইডির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ধামাকা ও এসপিসি ওয়ার্ল্ডের প্ল্যাটফর্মের আড়ালে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছেন তারা। তদন্তের পর অর্থ পাচারের বিষয়টি প্রমাণ হওয়ায় দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিআইডি মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেছে। বনানী থানায় ধামাকার প্রধান চিশতিসহ ছয়জনকে আসামি করে মামলা হয়। আর কলাবাগান থানায় মামলা হয় এসপিসির কর্ণধার আলামিনের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ ডটকমের মালিক জুয়েল রানা এরই মধ্যে ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়টি অবহিত করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’র পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বনানী থানায় মামলা করা হয়। এজাহারে বলা হয়, স¤প্রতি সিরাজগঞ্জ ডটকমের রিফান্ড রিকোয়েস্ট অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ‘নগদের’ কাছে ধরা পড়ে। এ ছাড়া একই পরিমাণ টাকা একই হিসাব নম্বরে বারবার দেয়ার জন্য রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করা হচ্ছিল। অদ্ভুত বিষয় হলো, সফলভাবে পণ্য ডেলিভারি হয়ে গেছে- এমন অর্ডারের বিপরীতেও রিফান্ড রিকোয়েস্ট আসছিল। এ ছাড়া অর্ডার এ্যামাউন্টের সঙ্গে রিফান্ড এ্যামাউন্টের গরমিল। গভীর রাতে রিফান্ড রিকোয়েস্ট আসতে থাকে প্রচুর।
এ বিষয়টি ধরা পড়ার পর ‘নগদ’ সিরাজগঞ্জ ডটকমের সঙ্গে তাদের সব লেনদেন স্থগিত করে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে ই-মানি আকারের ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা প্রতারণামূলকভাবে নিয়ে যায়। এরপর নগদের পক্ষ থেকে সিরাজগঞ্জ ডটকমকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়। সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নগদকে একটি চিঠি দেয়া হয়। এরপর থেকে সিরাজগঞ্জ ডটকমের মালিকের ফোন বন্ধ। সিরাজগঞ্জ শহরের বাহিরগোলা ও এমএ মতিন সড়কে সিরাজগঞ্জশপ ডটকমের প্রধান ও আঞ্চলিক অফিস দুটি দুই সপ্তাহ ধরে তালাবদ্ধ। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ আসবাব সরানো হয়েছে। কোম্পানির ডেলিভারি গাড়িগুলোও রহস্যজনকভাবে লাপাত্তা।
এ বিষয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ধামাকা ও এসপিসির বিরুদ্ধে অর্থ পাচার করার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের এ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তারা পলাতক। আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। ধামাকা ও এসপিসি ছাড়াও আরও কয়েকটি ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ছায়া অনুসন্ধান করছে সিআইডি। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে তাদের বিরুদ্ধেও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে।’