স্বপ্ন পূরণের নাম বাংলাদেশ

ফানাম নিউজ
  ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:৫৮

লাল-সবুজের মানচিত্র। ৩০ লাখ শহিদের রক্ত দিয়ে আঁকা ছবি। ৫০ বছর আগে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু, যা এরই মধ্যে বিশ্বদরবারে উন্নয়নের বিস্ময় নামে পরিচিতি পেয়েছে। বন্যা, দুর্যোগ এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন অর্থনীতি ও আর্থসামাজিকসহ বেশির ভাগ সূচকে উদীয়মান একটি রাষ্ট্র।

নিজস্ব টাকায় পদ্মা সেতু করে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। মহাকাশে জানান দিয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। কঠোর লড়াইয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটি শূন্য থেকে আজ বৈশ্বিক উৎপাদনের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।

অর্থনীতির আকারে বর্তমানে বিশ্বে ৪০তম বাংলাদেশ। ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, তৈরি পোশাকে দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়। চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলুতে সপ্তম। ক্রিকেটে, আউটসোর্সিং ও বাইসাইকেল রপ্তানিতে অষ্টম।

পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফলে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। এ অর্জন শহিদদের জানান দেয়, তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ৫০ বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-আজ সেই স্বপ্ন পূরণের নাম বাংলাদেশ। আজীবন লড়াই-সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রথম স্বপ্নটি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়িত করেছিলেন।

বাঙালিকে এনে দিয়েছেন মহান স্বাধীনতা। সেই স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ করে চলেছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭১ সালে আজকের দিনে সৃষ্টি হয়েছে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার ইতিহাস। ৩০ লাখ শহিদের তাজা রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র ও লাল-সবুজের পতাকা।

পৃথিবীতে এত দাম দিয়ে আর কোনো দেশকে হয়তো পতাকা কিনতে হয়নি। তাইতো বাঙালি স্বপ্ন দেখছে সোনার বাংলা গড়ার। এটি শুধু একটি দেশের স্বাধীনতাই নয়, বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পরাধীনতার শিকল ভেঙে বের হওয়ার প্রেরণাও বটে।

শুধু তাই নয়, কীভাবে একটি নিরস্ত্র জাতি মনের জোরে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনীকে মাত্র ৯ মাসে হার মানাতে বাধ্য করে, তা সারা বিশ্বে স্থাপিত হয়েছে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হিসাবে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও বঞ্চনা থেকে মুক্তির ইতিহাস, বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও উচ্ছ্বাস। স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি।

২৫ বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করছেন জার্মান সাংবাদিক ড্যানিয়েল সিডল। তিনি তার বইয়ে বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশের সাফল্যের ৫০টি গল্প তুলে ধরেছেন। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাফল্যের পাশাপাশি আছে ব্যর্থতাও। চেষ্টা চলছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার।

এখনো উন্নয়নে মূলবাধা দুর্নীতি। এছাড়াও সুশাসন প্রতিষ্ঠান ও নির্বাচনব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। সম্পদ, আয় ও ভোগবৈষম্যের কারণে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে না। তাদের মতে, এই ব্যর্থতা কাটিয়ে সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে যেতে হবে বহুদূর। 

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন।

অর্থাৎ, বাংলাদেশে কিছু থাকবে না। সেখান থেকে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, প্রাথমিক শিক্ষা এবং নারী শিক্ষাসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বিশাল অর্জন হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণে সুপারিশ মিলেছে। সেখানে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বেশ ভালো অবস্থান।

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন জার্মানির সাংবাদিক ড্যানিয়েল সিডল। বইয়ে বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের ৫০ বছর। বইয়ে বলা হয়েছে : দেশে লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৭ লাখ। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা দেশটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পতাকা সবুজ ও লাল।

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ম। মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। বাংলাদেশি নারী গড়ে ২.৩টি সন্তান জন্ম দিচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় যা সর্বনিম্ন। ৯৫ শতাংশ শিশু স্কুলে যায়। বাংলাদেশের মাতৃভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৩তম অর্থনীতির দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন নাগরিকরা। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি, গার্মেন্ট ও প্রবাসী আয়। সাইকেল-রিকশার শহর হিসাবে গিনেস বুকে নাম লেখিয়েছে ঢাকা।

বর্তমানে ১০ লাখের বেশি সাইকেল-রিকশা আছে এ শহরে। ১৬ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। উন্নয়নসংক্রান্ত বৈশ্বিক সূচকে ভারত-পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। সামগ্রিক সঞ্চয়, মাতৃমৃত্যু নিয়ন্ত্রণ, শিশুমৃত্যু রোধের ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বে দ্বিতীয় অংশগ্রহণকারী দেশ। এশিয়ার অর্থনীতির পাওয়ার হাউজ। গত কয়েক বছর মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি। জনসংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শহর ঢাকা।

বর্তমানে এ শহরের জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ। বিশ্বের ১৬০টি দেশে ১ কোটির বেশি প্রবাসী রয়েছে। এরা প্রতিবছর ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠায়। ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার নদনদী রয়েছে। কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বিবেচনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ মার্কিন ডলার, যা ভারতের চেয়ে বেশি। শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা হিসাবে বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। বর্তমানে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে এদেশে।

সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি নিুমানে রয়েছে। চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। ইউরোপের ৩০-৪০ শতাংশ পোশাক বাংলাদেশ থেকে যায়। পোশাক তৈরির জন্য যন্ত্রাংশ আমদানিতে বিশ্বের অন্যতম বাংলাদেশ। রানা প্লাজার পর পোশাক খাতে সংস্কারে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় বৃহত্তম ডেনিম রপ্তানিকারক দেশ। সরাসরি শিশুশ্রমের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে কম। বস্ত্র খাতে ৪৫ লাখ মানুষ সরাসরি কাজ করে। আর পরোক্ষভাবে এ খাতে নির্ভরশীল সাড়ে ৪ কোটি মানুষ। দ্রুত অটোমেশনে এবং ডিজিটাল সিস্টেমে যাচ্ছে।

নারীরা দেশের মেরুদণ্ড, পোশাক খাতে ৮০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক। ৮০ শতাংশ শিল্প বেসরকারি খাতে। চায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মান্তরে সম্পর্ক। এদেশ থেকে চা রপ্তানি হচ্ছে। আবার চাহিদার কারণে আমদানিও হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে অস্ত্র ছাড়া বাকি সব পণ্য শুল্কমুক্ত রপ্তানি করা যায়।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিওর স্বীকৃতি পেয়েছে ব্র্যাক। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের কাছে গড়ে একটি করে বাংলাদেশি পণ্য রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে শার্ট, প্যান্ট, জিন্স, জ্যাকেট ও পাটের ব্যাগ অন্যতম। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বিশ্বের অন্যতম দেশ।

বর্তমানে ৪০ লাখের বেশি পরিবারের ২ কোটির বেশি মানুষ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে অবস্থান দ্রুতই বাড়ছে। বর্তমানে ৬ লাখের বেশি সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। ক্রিকেটপ্রিয় দেশ। বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত বন্ধুত্ব ও অতিথিপরায়ণ।

এগুলো একসময় স্বপ্ন ছিল, এখন আর তা নয়। এর প্রায় সবই এখন বাস্তব। স্বপ্নগুলো পূরণ করেছে বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বিশ্বে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন মানচিত্র।

ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুরি বলে মন্তব্য করেছিলেন। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। আলোচ্য সময়ে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক সূচকে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

বাংলাদেশের মানুষের উদ্ভাবনী চিন্তাচেতনার বাস্তবায়ন ও উদ্যোগী মনোভাবের কারণে দেশটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সম্পদ উন্নয়নের দিক থেকে অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশুমৃত্যুর হার, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, বৈদেশিক শ্রমবাজার, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি অন্যতম।

এছাড়া জননিরাপত্তা, সামাজিক বৈষম্য নিরসনসহ উল্লিখিত প্রায় সব সূচকেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে এশিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।

মানুষের গড় আয়ু, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মাথাপিছু আয়ে যেসব দেশ বিশ্বে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এর মধ্যে নিুমধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতিও মিলেছে।

যে দেশকে শোষণ, বঞ্চনা, নানাবিধ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছিল পাকিস্তান, আজ তারাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে। শুধু তাই নয়, তাদের সংসদেও বাংলাদেশের উন্নয়নের উদাহরণ টানা হয়। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার, যা ১ বিলিয়নের কম।

বর্তমানে তা ৩৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, আলোচ্য সময়ে অর্থনীতির আকার ৬০০ গুণ বেড়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ওই সময়ে জাতীয় বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে তা ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে রাজস্ব আয় মাত্র ২৫০ কোটি টাকা থেকে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ৫০১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি আজ পৌঁছেছে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকায়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ২ কোটি ডলার। বর্তমানে তা ৪৪ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ, তা দিয়ে প্রায় এক বছরের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। দেশটির রিজার্ভের অর্থ দিয়ে মাত্র দুমাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। বর্তমানে তা ২৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে।

আমদানি মাত্র ২৮ কোটি ডলার থেকে ৫৩ বিলিয়ন, রপ্তানি ৩৩ কোটি থেকে পৌঁছেছে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) আসত ৮০ লাখ ডলার। ৫ দশকে তা ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে।

ওই সময়ে প্রতি মার্কিন ডলারের দাম ছিল সাত টাকা। বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম ৮৫ টাকা। অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৪৭ থেকে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। ১৯৭২ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৮৮ শতাংশ, সেখানে আজ এ হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

মূল্যস্ফীতি ৪৭ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশে নেমেছে। জাতিগঠনের অন্যতম উপাদান শিক্ষা। ৫০ বছরে সেখানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৭২ সালে শিক্ষার হার ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে তা ৭২ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

শিশুমৃত্য প্রতি হাজারে ১৬০ থেকে কমে ৩ দশমিক ৮ এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১৬ থেকে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশে নেমে এসেছে।১৯৭২ সালে ১০ হাজার ৪৯০ জন মানুষের জন্য একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছিলেন।বর্তমানে ২৫৮০ জনের জন্য একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আগে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হতো বৈদেশিক অনুদান থেকে। এখন প্রায় ৬৬ শতাংশ বরাদ্দ হয় দেশীয় সম্পদের উৎস থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ওই সময় ৪০ শতাংশ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো।

বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। কিন্তু কিছুটা খাদ্য আমদানি করা হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার খাদ্য রপ্তানিও করা হচ্ছে। ওই সময়ে দেশে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮ লাখ টন। বর্তমানে তা বেড়ে ৪ কোটি ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।

এছাড়া শিল্প খাতের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ৫০ বছরে কৃষিকে ছাড়িয়ে গেছে শিল্প। হালকা প্রকৌশল, সফটওয়্যার ও ওষুধ শিল্প অনেক এগিয়েছে। বর্তমানে গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। চীনের পরেই আমাদের অবস্থান।

এ গার্মেন্টই বিশ্বে ‘মেইড ইন বাংলাদেশকে’ পরিচিতি দিয়েছে। উন্নয়ন দেখতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন, শুধু বলার জন্য নয়, দারিদ্র্য বিমোচনে সত্যিই আজ ‘বিশ্বে রোল মডেল’।

সামগ্রিকভাবে দেশের অর্জনের তালিকা দীর্ঘ।অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি বেশি। এর অন্যতম হলো দারিদ্র্য বিমোচন। কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।

শিক্ষার হার বেড়েছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ থেকে উন্নয়নশীল থেকে উত্তরণের স্বীকৃতি এসেছে। বিশ্বব্যাংক থেকে স্বীকৃতি মিলেছে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার। এসব অর্জন বাংলাদেশের সক্ষমতার পাশাপাশি মর্যাদাও বাড়িয়েছে।

এছাড়া মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নারীর ক্ষমতায়, গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় বড় ভৌত অবকাঠামো অর্জনের পাল্লাকে অনেক ভারী করেছে। আরও আছে নিজস্ব স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন চলমান মেগা প্রকল্প।

আর সবকিছুকে ছাপিয়ে ক্রিকেটের অবিশ্বাস্য উন্নতি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নতুন রূপে পরিচিতি দিয়েছে। এসেছে বিশ্ব শান্তিতে নোবেলও। এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই দেশটি এখন বিশ্বে উন্নয়নের ‘রোড মডেল’। 

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দারিদ্র্য নিয়ন্ত্রণ। ইতোমধ্যে দেশের দরিদ্র পরিস্থিতি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্র সবার কাছে পৌঁছেছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্জন অনেক। এতে শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে শিক্ষার মানে পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতেও উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ তৈরি করার পাশাপাশি ওষুধের মূল্যও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তবে চিকিৎসকদের গুণগত মান এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছায়নি। এ মান বাড়াতে সরকারকে কাজ করতে হবে। 

বিশ্বের অন্যদেশগুলোর সামনে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরছে বিশ্বব্যাংক। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

মহাকাশে রয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট। বিশ্ব শান্তিতে নোবেল এসেছে বাংলাদেশে। ক্রিকেটেও বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে বাংলাদেশিরা। ১৯৭২ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৪০০ মেগাওয়াট।

চলতি বছর তা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। ৩ হাজার ৩১০ কিলোমিটার পাকা সড়ক থেকে ২২ হাজার কিলোমিটারে পৌঁছেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন থেকে আমরা ছিলাম বঞ্চিত।

অন্যান্য দেশের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে আমাদের স্থিতিশীলতা সন্তোষজনক। স্বাধীনতার মাত্র ৫ দশকেই বাংলাদেশ অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

সূত্র: যুগান্তর