শিরোনাম
বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী পলাতক চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ডের রায় আট বছরেও কার্যকর হয়নি। এ দুই ঘাতক বিদেশে অবস্থান করায় তাদের দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা হতাশা ব্যক্ত করেছে। তারা বলেন, মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি।
তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে এবং মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তাদের অপরাধ ও সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য জানার পরও তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বিভিন্ন দেশ থেকে পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেল গঠনের পরও কাউকেই ফেরানো সম্ভব হয়নি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সম্প্রতি এ নিয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা হয়েছে। সেখানে আমি এ দুইজনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দাবি করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, আমরা যেন ফর্মালি (আনুষ্ঠানিক) এই দাবি করি। আমি তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ফর্মালি দাবি করব।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, পলাতক আশরাফুজ্জামান ও মঈনুদ্দীনের সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার পর এখন তাদের ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আশা করি, দ্রুত তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, রায় বাস্তবায়ন না হলে বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে। পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদারকি সেল গঠন করে। এ সেলের অন্যতম সদস্য ও তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক সানাউল হক বলেন, পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে পুলিশ সদর দপ্তরের উদ্যোগে কমিটি গঠন হয়। এ কমিটির প্রধান একজন ডিআইজি। করোনার কারণে গত দুই বছর কোনো বৈঠক হয়নি। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
শহিদ সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে বর্তমান সরকার। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই জাতি পরিপূর্ণ স্বস্তিবোধ করবে। শহিদ ডা. ফজলে রাব্বীর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নুসরাত রাব্বী বলেন, দেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করতে চেয়েছিল আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীন। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হওয়া খুবই হতাশাজনক। তাদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। এতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি। অনেকের লাশ পাওয়া যায়নি। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ছয়জন সাংবাদিক, তিনজন চিকিৎসক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষকসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১১টি অভিযোগের মূলহোতা মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে এ হত্যা পরিকল্পনা ও টার্গেট ব্যক্তিদের একটি তালিকা পাওয়া যায়।
এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নিজামুদ্দীন আহমদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লা কায়সার, চিকিৎসক মো. ফজলে রাব্বী ও আলিম চৌধুরীকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। তবে ওই হত্যার মূল খলনায়ক ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। এ নৃশংস অপরাধের জন্য তারা ফাঁসির যোগ্য। তাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।
ফেনীর দাগনভূঞা থানার চাঁনপুর গ্রামে মঈনুদ্দীনের বাড়ি। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসাইন। একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের ছাত্র মঈনুদ্দীন দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসাবেও কাজ করেন। পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা আলবদর বাহিনীতে তাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্ব দেওয়া হয়। যুদ্ধের শেষভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যুক্তরাজ্যে যান। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। একাত্তরে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে থাকার কথা নিজের ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতিতে স্বীকার করেছেন তিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চৌধুরী মঈনুদ্দীন বলেছিলেন, তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হবেন না। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল একটি কৌতুক। সাজানো বিচার করা হচ্ছে।
আরেক খুনি আশরাফুজ্জামান খানের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে। বাবার নাম আজহার আলী খান। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান ঢাবির ইসলামি স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন।
এই দুই ঘাতক আত্মসমর্পণ না করায় তারা আপিলের সুযোগ হারায় এবং তাদের ফিরিয়ে এনে এখনও দণ্ড কার্যকর করা যায়নি।
সূত্র: যুগান্তর