শিরোনাম
দেশের কৃষির অনেক ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। বিনাধান, বিনাসরিষা, বিনাটমেটো উৎপাদনে এই ইনস্টিটিউট এনেছে প্রশংসনীয় পরিবর্তন। লবণসহিষ্ণু বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন, পাহাড়ের ফল সমতলে চাষ, শীতের ফল গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া চাষাবাদ, বারোমাসি বিভিন্ন ফলের জাতে উদ্ভাবনসহ অনেক ক্ষেত্রে তাদের সফলতা ঈর্ষণীয়। ফল নিয়ে গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটি করেছে কয়েকটি জার্মপ্লাজম সেন্টার। গবেষণাধীন প্রায় তিনশ’ জাত। আগামী তিন বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে উন্মুক্ত করার পর্যায়ে রয়েছে এমন কয়েকটি ফল নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে সরেজমিনে থেকে কথা বলেছেন বিনার হর্টিকালচার ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম মিঠু।
বিনার মিনি জার্মপ্লাজম সেন্টারটি ঘুরিয়ে দেখিয়ে শিগগির বাজারে উন্মুক্ত করা যাবে এমন কয়েকটি উদ্ভাবন দেখান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমাদের একটি বরইয়ের জাত আছে, যেটা অনেক দেরিতে পাকবে বা খাওয়ার উপযোগী হবে। বাজারে আমরা যে বরইগুলো সাধারণত এখন পাই সেগুলো মার্চ-এপ্রিলেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এটি হারভেস্ট করা যাবে জুন-জুলাইয়ে। যখন আম শেষের দিকে তখন এ বরই পাওয়া যাবে। তিন-চারটি ধাপে এ বরইটা গাছে ধরে। যেমন এখন কোনোটা একটু বড়, কোনোটা মাঝারি, কোনোটা ছোট, আবার কোনো ডালে দেখা যাচ্ছে মাত্র ফুল আসছে। দীর্ঘ সময় ধরে এটি গাছে থাকবে। তাই খাওয়া কিংবা বিক্রির ক্ষেত্রেও এটা অন্য রকম হবে।
‘বরইয়ের স্বাদটাকে আমরা দীর্ঘায়িত করতে পারবো বলে আশা করছি। আর এটা পুরো দেশি ভ্যারাইটি। আমাদের এ বরই সর্বোচ্চ ১৭৩ গ্রাম হবে। স্বাদে টক-মিষ্টি, সোনালি রঙের। খেতে বেশ ভালো। যারা খেয়েছে সবাই পছন্দ করেছে। সামনেই আমরা জাতটা ছেড়ে দেবো।’
দেশি একটি পেয়ারার জাত নিয়ে কাজ করছে বিনা। এটাও অ্যাডভান্স লাইনে আছে। ফল খুব বড় হবে না কিন্তু কচকচে, ক্রিসপি হবে। দানাও হবে নরম, ছোট। খেতে বেশ ভালো হবে। খুব বড় হবে না। কাজি পেয়ার মতো গাল ছিলবে না। আগামী, জুন-জুলাইয়ে এটি বাজারে ছাড়ার আশা করছেন তারা। এর সর্বোচ্চ ওজন হতে পার সাড়ে তিনশ’ গ্রাম।
পেয়ারা বাগান থেকে এবার ডালিমের বাগানে প্রবেশ। সেখানে মিঠু বলেন, ডালিমের একটি জাতও আমাদের অ্যাডভান্স লাইনে আছে। ডালিম বা বেদানা আমরা বিভিন্ন নামে ডাকি। এই জাতটি আমরা ভারত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে সংগ্রহ করেছি। এটা বেদানা গ্রুপের একটি জাত। বাংলাদেশের ডালিমের প্রধান সমস্যা হলো বিচিটা শক্ত হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের রোগ-পোকামাকড়ের আক্রমণে ঠিকভাবে চাষ করতে পারি না। এই জাতটা যদি আমরা বাজারে ছাড়তে পারি তাহলে আমরা মনে করি বিদেশ থেকে আর আমদানি করতে হবে না।
‘আমাদের বারোমাসি জাতের একটি লেবু আছে, যেটি থেকে সারা বছর লেবু পাওয়া যাবে। এটিও সামনে ছাড়বো। ভারতের নদীয়া থেকে আমরা কমলার একটি জাত সংগ্রহ করেছি। এই জাতটা আমাদের মাটির জন্য বিশেষ উপযোগী। খুবই মিষ্টি এবং রসালো বেশি। চামড়াটাও খুব বেশি মোটা হয় না। একটি মাল্টাও আমরা সামনে নিয়ে আসছি। যেটার সাইজটা বেশ বড় হবে। চারশ’ গ্রামের মতো হবে। এটা রসালোও বেশি।’
স্বল্পমেয়াদি ফল জাম নিয়ে নতুন তথ্য দেন এই জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জামের কোনো ভ্যারাইটি আমাদের দেশে নেই। এখানে অনেকগুলো জামের জার্মপ্লাজম আছে। জাম খুব অল্প সময়ের ফল। জামের একটি ভ্যারাইটি আমরা সংগ্রহ করেছি। এর বীজটা খুবই ছোট এবং মিষ্টি। অনেকে বলেছে এত ভালো জাম আগে কখনো খাননি। রাজশাহী থেকে এটা সংগ্রহ করা। উনি শিক্ষক। তিনি আবার উড়িষ্যা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। জাতটা আমরা শিগগির ছেড়ে দেবো।
জাম থেকে সফেদার বাগানে গিয়ে দেখা গেলো গাছে বিভিন্ন আকৃতির সফেদা। কয়েকটি সফেদা আবার লম্বা। মিঠু বলেন, আমাদের সফেদার অনেকগুলো জাত আছে। ভিয়েতনাম থেকে সংগ্রহ করা। অনেকগুলো গোল আবার অনেকগুলো লম্বা। সিলেকশন পদ্ধতিতে আমরা এটা নিয়ে এগোচ্ছি। কাজুবাদামের যে জাতটা সংগ্রহ করেছি সেটা নিয়েও কাজ চলছে। আমাদের টার্গেট শুধু পাহাড় নয়, সমতল ভূমিতেও যেন কাজুবাদাম ফলানো যায়। নোনা এলাকাতেও যেন হয়। এছাড়া কদবেল নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা কমার্সিয়ালি চিন্তা করছি। একটি বড় জাতের কদবেল আমাদের আছে। যেটার ওজন পাঁচশ’ গ্রামের ওপরে হয়।
জার্মপ্লাজম সেন্টার নিয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে মূলত আমরা এই জার্মপ্লাজম সেন্টারের কাজ শুরু করি। দেশের প্রধান ফল, অপ্রধান ফল, বিলুপ্তপ্রায় ফল যেগুলো আছে এবং দেশের বাইরের যে ফলগুলো আছে সেগুলো এক জায়গায় নিয়ে এসে ধরে রাখা। ল্যাবে কোনো একটা ফলের বীজ ধরে রাখছি। সেটা ফিল্ডেও হতে পারে। এটা ফিল্ডে রাখা। জিন থেকে জার্ম। ট্রপিক্যাল ও সাব-ট্রপিক্যাল ফলগুলো আমাদের দেশে ভালো হচ্ছে। শীতের ফলগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি।
‘এছাড়া এখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি ও গাজীপুরের শ্রীপুরে সাড়ে ২২ একর জায়গায় আরেকটি জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে উঠছে। দেশের প্রধান ফল, অপ্রধান ফল, বহুস্তর বাগান নিয়েও আমরা কাজ করি।’
কর্মপদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, এখানে দু’ভাবে কাজ চলে। যেমন সিলেকশনের মাধ্যমে যেটা ভালো পারফর্ম করে সেটা নিয়ে কাজ করি। আরেকটা হলো মিউটেশন ব্রিডিং। ফিজিক্যাল মিউটেশনে আমরা গামা রেডিয়েশন দেই এবং কেমিক্যাল মিউটেশনে আমরা ইথেন, মিথেন, সালফেনামাইড দিয়ে ভেতরে জেনেটিক্যাল লেভেলে পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন কোনো ভ্যারাইটি আনার চেষ্টা করি। আমাদের অনেকগুলো অ্যাডভান্স লাইন আছে।
এই মুহূর্তে বিনার কাছে তিনশ’ জাতের ১৩শ’ মাতৃগাছ আছে দাবি করে এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, এই জাতগুলো নিয়ে আমরা গবেষণা করছি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও বিদেশ থেকে এগুলো সংগ্রহ করা। এই মুহূর্তে ১৯টি দেশের ৩৬ রকমের বিদেশি ফল আছে। সব ধরনের ফলই আমরা সংগ্রহ করি। ভারত, আমেরিকা, চীন, জাপান, কানাডা, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতির দেশের ফলের জাত আমাদের সংগ্রহে আছে। যেমন ভিয়েতনাম থেকে আমরা কাজুবাদাম ও কফি সংগ্রহ করেছি। মিল্ক ফ্রুট বা স্টার আপেলও আমরা সংগ্রহ করেছি।
বিনার গবেষণায় দেশে ফল আবাদের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে বলে মনে করেন বিনার জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম মিঠু।
সূত্র: জাগো নিউজ