শিরোনাম
নদীগুলো জালের মতো বিছিয়ে আছে বাংলাদেশের শরীরজুড়ে। যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম আমাদের নৌপথ। কিন্তু নাব্য সংকট ভোগাচ্ছে দীর্ঘদিন। কমছে নৌপথ, বিঘ্ন ঘটছে নৌযান চলাচলে। শীতকালে নদীর পানি কমে গেলে সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। শীত মৌসুম আসতে না আসতেই এরই মধ্যে বিভিন্ন নৌরুটে দেখা দিয়েছে নাব্য সংকট।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে এখন মোট নৌপথ প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার। তবে শুষ্ক মৌসুমে তা আরও কমে যায়। সচল রাখা ও বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌপথ ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিংই একমাত্র উপায়। কিন্তু প্রতি বছর চাহিদার অর্ধেক নদীও ড্রেজিং করতে পারে না সরকার।
নদী খননের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা জানান, বছরে দেশে ড্রেজিংয়ের চাহিদা পাঁচ কোটি ঘনমিটারের মতো। উন্নয়ন (ডেভেলপমেন্ট) ও সংরক্ষণ (মেইটেন্যান্স) খননের আওতায় বিআইডব্লিউটিএ দুই থেকে আড়াই কোটি ঘনফুট ড্রেজিং করে।
কর্মকর্তারা জানান, ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে বাজেট কম। তাই গুরুত্বপূর্ণ লঞ্চ ও ফেরি রুটগুলো সচল রাখার দিকেই নজর বেশি থাকে বিআইডব্লিউটিএ’র। চলতি শীত মৌসুম সামনে রেখে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলোতে ড্রেজিং শুরু হয়েছে।
ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে বাজেট স্বল্পতা ছাড়াও বিআইডব্লিউটিএকে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ড্রেজিং করে মাটি ফেলার জায়গা পাওয়া যায় না। নদীর মাটি নদীতেই ফেলতে হয়। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা জানান, নাব্য সংকটের কারণে লঞ্চ চলাচলে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নন লঞ্চ মালিকরা।
বিআইডব্লিউটিএ’র তথ্যানুযায়ী, গত ৪০ বছরে ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ বর্তমানে ৪৫টি ড্রেজার ও বেসরকারিভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে ড্রেজিং করে। নদী খননের সক্ষমতা বাড়াতে আরও ৩৫টি ড্রেজার কেনার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
বরিশালের কীর্তনখোলা নদী থেকে ঝালকাঠির সুগন্ধা হয়ে বিষখালী নদী পাড়ি দিয়ে নৌযানে চলাচল করতে হয় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। কিন্তু সিগন্যাল বাতি না থাকায় বিষখালী নদীতে ডুবোচরে একের পর এক আটকা পড়ছে যাত্রীবাহী লঞ্চ। এতে দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
গত সেপ্টেম্বরে ঝালকাঠির রাজাপুরের বিষখালী নদীতে সিগন্যাল বাতি না থাকায় ঢাকা টু বরগুনাগামী পূবালী-১ নামের একটি দোতলা লঞ্চ ডুবোচরে উঠে কয়েকদিন আটকা থাকে। এর আগে ১৩ আগস্ট একই স্থানে অভিযান-১০ নামে একটি লঞ্চ আটকে যায়। ১৫ দিন পর ওই লঞ্চটি উদ্ধার করা হয়েছিল। এর দু’সপ্তাহ পর অমাবস্যার জোয়ারে বাড়া পানিতে চরে উঠে আটকে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শাহরুখ। সেটাও কয়েকদিন পর নামিয়ে নেওয়া হয়।
বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, নাব্য সংকটের কারণে নৌ-চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তা নয়। সমস্যায় পড়তে হয়। এখন সারাদেশে ৭৮০টি জলযান চলাচল করে। এরা আমাদের রুট পারমিট নিয়ে চলছে। সারাদেশে মোট ১৪৫টির মতো রুট আছে।
গুরুত্বপূর্ণ নৌ-রুটগুলোতে বেশি নজর রাখতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এসব রুটকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। পুরোটা তো ড্রেজিং করা যায় না। সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। এখন পর্যন্ত ৫-৬টি রুটের বিষয়ে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি। সেখানে নাব্যতার সমস্যা হচ্ছে। জোয়ার ধরে চলতে হচ্ছে।
ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৩টি রুট আছে জানিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ৪৩টির মধ্যে ৫-৬টির সমস্যা রয়েছে। ঢাকা-রাঙ্গাবালী রুটে সমস্যা হচ্ছে। প্রস্তুতি চলছে আমরা হয়তো শিগগির এটার ড্রেজিংয়ে হাত দেবো। ঢাকা-রায়েন্দা, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-বরগুনা নৌরুটেও নাব্য সংকট রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত পরিচালক (নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন) আব্দুল মতিন সরকার বলেন, আমরা নৌপথ চিহ্নিত করার কাজটি করি। কোথাও নাব্য সংকট দেখা দিলে সেখানে বয়া-বাতি দিয়ে সংকেত দেওয়া হয়। ড্রেজিংয়ের জন্য আমরা ড্রেজিং বিভাগকে জানাই।
তিনি বলেন, এবার শুষ্ক মৌসুম সামনে রেখে ড্রেজিং বিভাগকে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে বলেছি। তারা কাজ করছে। আশা করছি, নাব্য সংকটের জন্য কোথাও নৌ-চলাচল বন্ধ হবে না। আমরা সজাগ আছি।
আব্দুল মতিন আরও বলেন, পণ্যবাহী জাহাজ আমাদের পাইলট বিট থেকে সামান্য ফি দিয়ে পাইলট নেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা নেন না। তাই দেখা যায়, অনেক সময় জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে। এই নিয়ম সবার মানা উচিত।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থার সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ইতোমধ্যে ৩০ নৌরুটে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। সেটা উপেক্ষা করেই আমরা লঞ্চ চালাচ্ছি। আমরা বিআইডব্লিউটিএকে ক্রমাগত বলেই যাচ্ছি। তাদের বিস্তারিত তালিকা দিয়েছি। সব নদীতেই কমবেশি ড্রেজিং করা দরকার। পদক্ষেপ না নিলে সামনে লঞ্চ চালানোর ক্ষেত্রে আরও বড় সমস্যায় পড়তে হবে।
ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ’র পদক্ষেপ সন্তোজনক নয় জানিয়ে তিনি বলেন, চ্যানেল বন্ধ হয়, আরেক চ্যানেল দিয়ে লঞ্চ যেতে হয়। ৫-১০ মাইল ঘুরে যেতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, নাব্য সংকট প্রতি বছরের সমস্যা। তবে কোনো স্থানে নাব্য সংকট দেখা দিলে আমাদের লঞ্চে বড় বড় ইঞ্জিন চলায় নতুন করে চ্যানেল তৈরি হয়। সরকারও ড্রেজিং করে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. আব্দুল মতিন বলেন, প্রতি বছরই আমাদের নৌপথ মেনটেইন করতে হয়। সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চাহিদাও থাকে। লঞ্চ মালিক, কার্গো ভেসেল ও ট্যাঙ্কার মালিক সমিতির কাছ থেকে শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই একটা চাহিদা নেই। বিআইডব্লিউটিসিও আমাদের জানায়, তাদের কোন কোন ফেরি রুটে ড্রেজিং করতে হবে। আমাদের নিজস্ব ডিপার্টমেন্টও জানায় কোথায় ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। আমরা একটা তালিকা করি এবছর কোথায় কোথায় ড্রেজিং করবো। মেনটেন্যান্স বাজেট যা থাকে, সে অনুযায়ী টেন্ডার করি। আমরা অগ্রাধিকার তালিকা করে সেটা অনুযায়ী কাজ করি। কারণ আমাদের পুরোটা করার বাজেট নেই।
‘প্রতি বছর খননের চাহিদা থাকে সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি ঘনমিটার। মেনটেন্যান্স ও ডেভেলপমেন্ট মিলিয়ে সক্ষমতা দুই থেকে আড়াই কোটি ঘনমিটার। চাহিদাও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। সক্ষমতা বাড়াতে আরও ৩৫টি ড্রেজার কেনার প্রক্রিয়া চলছে।’
তিনি বলেন, আমাদের ৪৫টি ড্রেজার আছে। সেগুলো নিয়ে সারাদেশের জন্য একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। ঠিক করি, এই জায়গাগুলোতে বাজেট অনুযায়ী প্রাইভেট ড্রেজার দিয়ে করবো। এই জায়গাগুলোতে আমার নিজের ড্রেজার দিয়ে ড্রেজিং করবো। এবছরের কাজ আমরা এরই মধ্যে শুরু করেছি। এবছরের টেন্ডারও প্রায় শেষ।
মোটামুটি সবগুলো ফেরি রুটের ড্রেজিংয়ের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, এর বাইরে দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান লঞ্চ রুটগুলোতেও ড্রেজিং করা হবে। ভারতের সঙ্গে নৌ-প্রটোকলের আওতায় থাকা সিরাজগঞ্জ-দৈখাওয়া ও আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ পর্যন্ত নৌরুটেও ড্রেজিং করা হচ্ছে। ভাসানচর, সন্দ্বীপ চ্যানেল আগে ছিল না। এখন আমাদের মেনটেইন করতে হচ্ছে। প্রটোকল নৌপথ খননের ক্ষেত্রে ভারত ৮০ শতাংশ খরচ বহন করে।
বিআইডব্লিউটিএ’র এক কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে ঢাকা-পটুয়াখালী-গলাচিপা, আমতলী-পুরাকাটা, ঢাকা-লক্ষ্মীপুর, বরিশাল বন্দর এলাকা, কক্সবাজার-মহেশখালী, ঢাকা-ডামুড্যা, হরিণা-আলুবাজার, পাতারহাট-বরিশাল, কুমিরা-সন্দ্বীপ, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরিচা-বাঘাবাড়ী-সিরাজগঞ্জ, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি নৌরুটের ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে।
তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা নদী খনন হচ্ছে। বিআইব্লিউটিএ ও বেসরকারি ড্রেজার এই রুটগুলো খননকাজ করছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানান, প্রতি বছর পাঁচ কোটি ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের চাহিদা পাওয়া যায়। তবে এক কোটি ৩০ থেকে দেড় কোটি ঘনমিটার ড্রেজিং করতে পারে বিআইব্লিউটিএ। প্রচুর পলি আসে, শীতের সময় নদীর পানি কমে যায়। তাই প্রতি বছরের নাব্য সংকট অনেকটা একই রকম।
ড্রেজিং বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক নৌপথ আছে যেগুলো শুকিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। সেগুলো ড্রেজিং করার চাহিদা আছে। আমরা তা করতে পারছি না। ভৈরবে কয়েকটি নদী শুকিয়ে গেছে। সেগুলো ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে থাকতে হয়। এছাড়া আমাদের মেনটেন্যান্স বাজেটও কম। মূল নৌপথগুলো সচল রাখার দিকেই নজর বেশি আমাদের।
নৌ-সংরক্ষণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বরিশালের বাকেরগঞ্জের কবাই নদীতে নাব্য সংকট রয়েছে। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী যেতে এ নৌপথ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু সেখানে ড্রেজিং করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ড্রেজিং করা মাটি ফেলার জায়গা পাওয়া যচ্ছিল না। পরে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, অনেক স্থানেই এমন সমস্যা দেখা দেয়। তাই অনেক সময় ড্রেজিং করে নদীর মাটি নদীতে ফেলানো ছাড়া উপায় থাকে না।
সূত্র: জাগো নিউজ