‘আবরারের প্রতি দেশবাসীর ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় পাওয়া’

ফানাম নিউজ
  ২৯ নভেম্বর ২০২১, ১১:২৪

‘মানুষ সন্তানের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করে। আমার তো কিছুই আর পাওয়ার নেই। মানুষের অন্তরে আমার ছেলের জন্য যে ভালোবাসা জেগেছে, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। দেশবাসী তার প্রতি যে সহানুভূতি জানিয়েছে, সেটাই আমার বড় প্রাপ্তি।’

কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ।

রোববার (২৮ নভেম্বর) আবরার হত্যা মামলার রায় ঘোষণার কথা ছিল। তবে রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক।

সন্তানহারা বরকত উল্লাহকে তাই খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। ছেলের খুনিদের দণ্ড শুনতে তাকে অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। রায় ঘোষণার তারিখ পেছানোর পর কিছুটা হতাশ আবরারের বাবা। রোববার আদালত প্রাঙ্গণে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

আবরারের বেড়ে ওঠা নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বরকত উল্লাহ বলেন, ‘আমি দূরে চাকরি করতাম। বাড়িতে সংসার দেখাশোনা করতো আবরারের মা। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের কখনো একা ছাড়েনি ওদের মা। স্কুলে আনা-নেওয়া করতো ওই মা। এসএসসি পাশ করার আগ পর্যন্ত আবরার মায়ের সঙ্গে আসা-যাওয়া করেছে। যখন যেটা প্রয়োজন হয়েছে, তখন সেটা তার মা এনে দিয়েছে। আমরা ছেলেটাকে কোনোদিন বাইরে কোনো জিনিস কিনতেও পাঠানো হয়নি।’

বরকত উল্লাহ নিজে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছেলেকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বুয়েটে পড়তে পাঠিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণা থাকলেও র‌্যাগিংয়ের নামে নির্মম অত্যাচারের বিষয়ে অতোটা জানতেন না তিনি।

বরকত উল্লাহ বলেন, ‘র‍্যাগিং হয় শুনেছি। তবে এমন অত্যাচার যে এখন চলে, তা আমার জানা ছিল না। জানলে হয়তো আমি আবরারকে বুয়েটে ভর্তি করাতাম না। অন্য কোথাও রেখে ছেলেকে পড়াতাম। ওর মা এখন প্রায়ই বলে, ঢাকায় লেখাপড়া করতে পাঠানোয় আবরারের জন্য কাল হয়েছে।’

‘আবরার ফাহাদ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, কোরআন পড়তো। তাকে নির্মম-নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ যন্ত্রণা বাবা হিসেবে সইতে পারি না’ যোগ করেন আবরারের বাবা।

ছেলেকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। হঠাৎ সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তবে আবরারের জন্য বুয়েট তথা গোটা দেশ জেগে ওঠে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামে মানুষ। দেশের বাইরে থেকে অগণিত মানুষ তার প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা জানিয়েছে।

এ বিষয়গুলো নিয়ে বাবা হিসেবে তার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে বরকত উল্লাহ বলেন, ‘যারা আবরারের জন্য ভালোবাসা ও সহানুভূতি জানিয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ। তারা আমাদের সুরে সুর মিলিয়ে বিচার চেয়েছেন। তাই আমি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। যাতে এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে এসে যেন কাউকে এভাবে প্রাণ দিতে না হয়। অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার না হয়। কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং বন্ধ হয়। তা নিশ্চিত করতে হবে।’

আবরার ফাহাদ চলে গেছেন। যারা আপনার সন্তানের বয়সী, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের উদ্দেশে কী বলতে চান....? প্রশ্ন শেষ না হতেই বরকত উল্লাহ বলেন, ‘আমি বলবো, তোমাদের বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। তোমরা চোখ-কান খোলা রেখে চলবে। অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে।’

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ওইদিন রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

পরদিন ৭ অক্টোবর দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরারের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। নিহত আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি।

ওই ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।

অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন ও তদন্তে প্রাপ্ত আরও ছয়জন রয়েছেন। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জন এবং এজাহারবহির্ভূত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন।

গ্রেফতার ২২ জন হলেন- মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মেহেদী হাসান রবিন, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, মুনতাসির আলম জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির, মুজাহিদুর রহমান, মুহতাসিম ফুয়াদ, মনিরুজ্জামান মনির, আকাশ হোসেন, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মাজেদুর রহমান, শামীম বিল্লাহ, মোয়াজ আবু হুরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত, ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু।

মামলার তিন আসামি এখনো পলাতক। তারা হলেন- মোর্শেদুজ্জামান জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোস্তবা রাফিদ। তাদের মধ্যে প্রথম দুজন এজাহারভুক্ত ও শেষের জন এজাহারবহির্ভূত আসামি।

২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। মামলায় মোট ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।

গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২৮ নভেম্বর রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন। রোববার নির্ধারিত দিনে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা জন্য কারাগার থেকে ২২ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। তবে রায় প্রস্তুত নয় বলে বিচারক ঘোষণার তারিখ পুনর্নির্ধারণ করেন।

রোববার দুপুর ১২টা ৭ মিনিটে এজলাসে ওঠেন বিচারক। এরপর বিচারক বলেন, রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা যে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা বিশ্লেষণ করে রায় প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। রায় প্রস্তুত করতে আরও সময় লাগবে। তাই এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৮ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হলো।

সূত্র: জাগো নিউজ