সড়কে রপ্তানির জটিলতা কাটছেই না

ফানাম নিউজ
  ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১২:৩৭

বাংলাদেশ থেকে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। সড়কে যাওয়া পণ্যগুলোর গন্তব্য কম দূরত্বের দেশগুলো। প্লেন বা উড়োজাহাজে বেশি যাচ্ছে পচনশীল পণ্য। কিন্তু রপ্তানির সবচেয়ে বড় কারবার হচ্ছে জাহাজের মাধ্যমে। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশে পণ্য যাচ্ছে নৌপথে। বর্তমানে এ তিন পথেরই বড় সমস্যা বাড়তি ভাড়া। পাশাপাশি অন্য সমস্যাও রয়েছে। সেসব সমস্যার বিষয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।

জাহাজের মতো আকাশচুম্বী না হলেও করোনার ধাক্কায় সড়কপথে পণ্য রপ্তানিতেও খরচ বেড়েছে। এ পথে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ বাধা এখনো প্রকট। কাটেনি অন্যান্য জটিলতাও। নিকটতম বাজারে পণ্য রপ্তানিতে সড়কপথই সুবিধাজনক হলেও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য এ পথ এখনো অমসৃণই থেকে গেছে।

বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল ও ভুটানে সড়কপথে পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের তিন পাশে ভারতের সীমানা থাকায় নেপাল-ভুটানে পণ্য পাঠাতে হয় ভারতের সড়ক ব্যবহার করে। এ কারণে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক।

জানা গেছে, দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠান এখন ভারত, নেপাল ও ভুটান—এই তিন দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। যার মধ্যে ডজনখানেক বড় শিল্পগ্রুপ। এই তিন দেশে মাসে কয়েক লাখ টন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। যার প্রায় ৯০ শতাংশ যাচ্ছে সড়কে। এসব পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে ভারতে। ওই দেশে পণ্য রপ্তানির অংক দেড় বিলিয়নের মাইলফলক ছোঁয়ার পথে হাঁটছে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, সয়াবিন তেল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ইস্পাত, চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটের সুতা, মাছ ইত্যাদি।

তবে রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর পণ্য রপ্তানির পথ মসৃণ নয়। স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রপ্তানি হয়ে থাকে। আবার ভারতের সড়ক ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে সহযোগিতা মেলে কম। এজন্য খরচের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া ভারতে পণ্য খালাসেও সময় লাগে অনেক বেশি।

কয়েকজন রপ্তানিকারক জানান, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে মিউচুয়াল রিকগনিশন অ্যাগ্রিমেন্ট না থাকায় অনেক সময় বন্দরে পণ্যের মান সনদ নিতে ভোগান্তি পোহাতে হয় রপ্তানিকারকদের। দীর্ঘক্ষণ পণ্যের চালান বন্দরে পড়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন গুদামে সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় অনেক সময় পণ্য নষ্ট হয়ে যায়।

এসব বিষয়ে আকিজ প্লাস্টিকসের সিনিয়র ম্যানেজার (এক্সপোর্ট) অভিজিৎ দে সরকার বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারের (বাধা) কারণে আমাদের পণ্য রপ্তানিতে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। খরচও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া নেপাল-ভুটানের ক্ষেত্রে সেভাবে ভারতের সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

উদাহরণ দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে দূরত্ব কম হয় পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হয়ে গেলে। কিন্তু ভারতের ওপাশে পণ্য ছাড়তে অনেক বেশি ঝামেলা করে। এজন্য ওই দুই দেশের পণ্য লালমনিরহাটের বুড়িমারী বন্দর দিয়ে পাঠাতে হয়। এজন্য খরচ ও সময় উভয়ই বেশি লাগে।

পণ্যের ভারতীয় মান সনদ পাওয়া একটি বড় সমস্যা

সড়কে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে আরেকটি বড় সমস্যা হলো ভারতের মান সনদ পাওয়া। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে (সেভেন সিস্টার্স) আখাউড়া, সুতারকান্দি, তামাবিল দিয়ে খাদ্যপণ্যের চালান যায়। এরপর সেগুলো পরীক্ষার পর সনদ মিলতে সময় লাগে এক মাস। এসময় বন্দরে পণ্য আনলোড করে ট্রাকগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়, যাতে খরচ অনেক বেড়ে যায়।

পণ্য রপ্তানিতে ট্যারিফ- নন ট্যারিফ সমস্যা

এদিকে, ট্যারিফ-নন ট্যারিফ সমস্যার কারণে রপ্তানিতে মাঝে মাঝে জটিলতা তৈরি হয়। দেশের অন্যতম ভোজ্যতেল রপ্তানিকারক কোম্পানি সিটি গ্রুপ এই জটিলতার কারণে ভারতে তেল রপ্তানিই বন্ধ রেখেছে।

জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘ভারতে সয়াবিন তেলের বাজার অনেক বড়। কিন্তু এখন শুল্ক-অশুল্ক বাধার কারণে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি সরকার পোলট্রি ও ক্যাটল ফিড তথা মুরগি ও গোখাদ্য তৈরির অন্যতম কাঁচামাল সয়ামিল রপ্তানি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে।’

দীর্ঘদিন রপ্তানির সঙ্গে জড়িত এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যখন বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য রপ্তানি করা হয় তখন ভারতের তরফে আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হয় না। এছাড়া আমরা ভারতে পণ্য রপ্তানি করলে সাফটা (দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) সুবিধা পাই না। অথচ কোনো পণ্য আমদানি করতে গেলে সেই সুবিধা তাদের (ভারত) দিতে হয়।’

জানা গেছে, বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা না থাকায় সীমান্তে বাংলাদেশের ট্রাক থেকে পণ্য খালাস করে ভারতীয় ট্রাকে তুলতেও অনেক সময় নষ্ট হয়। নেপাল বা ভুটানে গেলে এ খালাস চলে ভারতের শেষপ্রান্তের সীমান্তেও। কয়েক দফা পণ্য খালাসে পরিবহনের খরচ বাড়ে কয়েক গুণ।

সমস্যা বাংলাদেশের বন্দরেও

শুধু ভারতের বন্দর নয়, সমস্যা রয়েছে বাংলাদেশের বন্দরেও। বাংলাদেশের ২৩টির বেশি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলছে। তবে বন্দরের অবকাঠামোগত অবস্থা বিবেচনা করে আমদানি-রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়। এই মুহূর্তে যশোরের বেনাপোলসহ দুই-একটা বন্দর বাদে অন্যান্য বন্দরগুলো সেকেলে। সেখানে পণ্য খালাসের সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। বেশিরভাগ সময় পণ্যজট লেগে থাকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আলমগীর বলেন, বাংলাদেশের স্থলবন্দরের কোনো সমস্যার কারণে রপ্তানি কার্যক্রমে বিঘ্ন কখনো হয়নি। আমাদের যেসব বন্দর দিয়ে রপ্তানি পণ্য যাচ্ছে, সেগুলোর উন্নত অবকাঠামো রয়েছে। সেখানে রপ্তানি পণ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পাঠাচ্ছি।

তিনি বলেন, নতুন আরও যেসব বন্দরের মাধ্যমে ভারত বা ভারত হয়ে অন্য দেশে পণ্য রপ্তানি সম্ভব সেগুলোও উন্নয়ন করা হচ্ছে। হবিগঞ্জের বাল্লা স্থলবন্দর উন্নয়ন হচ্ছে। আরও কিছু বন্দরের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির জন্য যত দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে, সেটা বেশিরভাগ দেশেই নেই।

জানা যায়, পণ্য রপ্তানিতে বড় শিল্পগ্রুপের মধ্যে এগিয়ে রয়েছে—প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, বেঙ্গল গ্রুপ, ওয়ালটন, রানার, সজিব গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব কোম্পানি ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে ডিউটি ফ্রি ও কোটা ফ্রি সুবিধা পাচ্ছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

সূত্র: জাগো নিউজ