কুমিল্লায় দুই হত্যাকাণ্ড: মুখোশধারী খুনিরা ছিল ছয় থেকে আটজন

ফানাম নিউজ
  ২৪ নভেম্বর ২০২১, ১২:৫৭
আপডেট  : ২৪ নভেম্বর ২০২১, ১৩:০৩

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য মো. সোহেল হত্যাকাণ্ডে মুখোশধারী ছয় থেকে আটজন অংশ নেয়। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে র‌্যাব প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। তবে পুরো শরীর ঢাকা থাকায় দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করা যায়নি।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বলছেন, এলাকায় সোহেলের কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল না। মাদক নির্মূল, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। মাদক ব্যবসা ঠেকাতে গিয়ে সোহেলের সঙ্গে সংরাইশ এলাকার কয়েকজনের বিরোধ ছিল। সর্বশেষ সপ্তাহখানেক আগে সোহেলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে সংরাইশ এলাকার সাব্বিরের সঙ্গে সোহেলের লোকজনের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

গত সোমবার বিকেল সাড়ে চারটায় নগরের পাথুরিয়াপাড়ায় নিজের রড-সিমেন্টের দোকান থ্রি স্টার এন্টারপ্রাইজে কাউন্সিলর মো. সোহেল ও তাঁর সহযোগী হরিপদ সাহাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় আরও চারজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁরা বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেলে নগরের সংরাইশ এলাকা থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

অস্ত্র উদ্ধার

গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় নগরের সংরাইশ বড় পুকুরপাড় এলাকায় আবদুর রহিমের বাড়ির পাশের গলি বেলাল আহমেদের বাড়ির সীমানাপ্রাচীর থেকে ২টি এলজি, ১টি পাইপগান, ১২টি গুলি, ১৫টি বোমাসদৃশ বস্তু, ২টি জামা ও ব্যাগ উদ্ধার করেছে পুলিশ। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনওয়ারুল আজিম প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ওসি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পেয়ে পুলিশ সংরাইশ বড় পুকুরপাড় এলাকার সীমানাপ্রাচীর ঘেরা একটি স্থান থেকে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে। ধারণা করা হচ্ছে, কাউন্সিলর সোহেল হত্যাকাণ্ডে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

জানাজায় মানুষের ঢল

গতকাল বেলা আড়াইটায় নগরের পাথুরিয়াপাড়া ঈদগাহ মাঠে কাউন্সিলর সোহেলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। এ সময় বক্তৃতা করেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, নিহত সোহেলের ছেলে সৈয়দ মো. হাফিজুল ইসলাম। পরে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মেয়র মো. মনিরুল হক বলেন, ‘সোহেল এলাকায় অনেক উন্নয়নকাজ করেছেন। তাঁর খুনিদের গ্রেপ্তার করতে হবে।’

এদিকে গুলিতে নিহত হরিপদ সাহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া গতকাল বেলা ১১টায় টিক্কারচর শ্মশানে অনুষ্ঠিত হয়।

কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা

এদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় কাউন্সিলর সোহেলের সাহাপাড়ার বাসায় মরদেহ আনা হয়। আগে থেকেই কয়েক শ নারী-পুরুষ সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। লাশবাহী গাড়ি থেকে মরদেহ নামানোর পর কান্নার রোল ওঠে।

সরেজমিনে পাথুরিয়াপাড়া এলাকায় সড়কের মধ্যে কয়েক শ মানুষের জটলা দেখা যায়। পুলিশ বসে আছে কাউন্সিলরের ব্যবসায়িক কার্যালয়ের পাশে। এ সময় অন্তত ১০ জন নারী বসে থাকা পুলিশ সদস্যের কাছে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।

সকাল সাড়ে ১০টায় সোহেলের লাশ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে ময়নাতদন্ত শেষে নগরের সাহাপাড়া এলাকায় আনা হয়। এ সময় সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারী ও পুরুষেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। লাশ নেওয়া হয় সোহেলের তিনতলা বাসার নিচতলায়। সেখানে লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা। সোহেলের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রুনা বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে রেকি করে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়।’

সোহেলের শ্বশুর হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘জনপ্রিয়তাই কাল হলো সোহেলের। ওরে পরিকল্পনা করে মারা হয়।’

আধিপত্য বিস্তার নিয়েই বিরোধ

২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে জয়ী হন মো. সোহেল। এরপর এলাকায় তাঁর প্রভাব বাড়ে। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ তিনি দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিলর হন। এই সময়ে তিনি ১৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য হন।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, সোহেলের উত্থান সহ্য করতে পারেননি পাশের ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন, সংরাইশের শাহআলম, সাব্বির ও ‘জেল সোহেল’। তাঁদের সঙ্গে কাউন্সিলর সোহেলের বিরোধ ছিল। ১৫ নভেম্বর সংরাইশ এলাকার সাব্বিবের সঙ্গে কাউন্সিলর সোহেলের লোকজনের গোলাগুলি হয়। পাথুরিয়াপাড়ায় কাউন্সিলরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। তখন সাব্বিরকে ‘ডাকাত’ বলে সম্বোধন করে সোহেলের লোকজন। এতে ক্ষিপ্ত হন সাব্বির। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, বউবাজার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসা ঠেকানো নিয়ে সোহেলের সঙ্গে সংরাইশের কয়েকজনের দ্বন্দ্ব ছিল। হত্যাকাণ্ডের পর এঁরা সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সোহেলের বাড়ির ফটকে কথা হয় কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খোকন ও মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক জি এস সহিদের সঙ্গে। তারা প্রায় অভিন্ন সুরে বললেন, এলাকায় তাঁর কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল না। মাদক নির্মূল, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি।

যা বলছে প্রশাসন

কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনওয়ারুল আজিম বলেন, গত সোমবার রাতে নগরের বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করছে।

জানতে চাইলে র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, ‘সিসিটিভি ক্যামেরার ছবি বিশ্লেষণ করে দেখেছি, হত্যাকাণ্ডে ছয় থেকে আটজন অংশ নেয়। মুখোশধারী হওয়ায় শনাক্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তদন্ত চলছে।’

জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, সোমবার বিকেল ৪টা ২০ থেকে ৪টা ২৫ মিনিটের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। গুলি করে, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।

আগের দুই খুনের অভিযোগপত্র হয়নি

আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় অন্তঃকোন্দল নিয়ে কুমিল্লায় এর আগে আরও দুজন খুন হন। এক বছর আগে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর জিল্লুর রহমান চৌধুরীকে ধনপুর এলাকায় কুপিয়ে এবং ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর দেলোয়ার হোসেনকে বল্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের সড়কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে জিল্লুর ছিলেন যুবলীগ নেতা; ২০১৭ সালে সিটি নির্বাচনে তিনি কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছিলেন। আর কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ারও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে একই বছর নির্বাচন করেছিলেন।

জিল্লুর হত্যার ঘটনায় তাঁর ভাই বাদী হয়ে সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলা করেন। পিবিআইয়ের পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিপুল দেবনাথ বলেন, এ মামলার ২১ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন তাঁরা জামিনে আছেন, তিনজন পলাতক। চলতি বছরের শেষে সাক্ষ্য–প্রমাণ নিয়ে তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

দেলোয়ার হত্যার ঘটনায় তাঁর বড় ভাই বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মতিউর রহমান জানান, এ মামলার প্রধান আসামি রেজাউল করিমসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে রেজাউল কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। অপর আসামিরা জামিনে আছেন। দুই মাসের মধ্যে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

সূত্র: প্রথম আলো