দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে বাড়ছে বাঘ-হরিণ

ফানাম নিউজ
  ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১১:৩৫

সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে গাছের ফাঁকে ফাঁকে হরিণের দৌড়াদৌড়ি। পাশে লাফালাফি করছে বানর। দস্যুমুক্ত হওয়ায় সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে নির্বিঘ্নে মাছ ধরছে জেলেরা। দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি করা পথের ধারে মাঝে মাঝে হরিণের পদচিহ্ন। এই পথ দিয়ে হরিণ ঝাঁক বেঁধে পানি খেতে যায় সমুদ্রে।

ভাটার সময় সমুদ্রতীরে গিয়ে দেখা যায়, কাদামাটিতে শত শত হরিণের পদচিহ্ন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল পর্যটকরা পৌঁছানোর আগে তারা এসেছিল এখানে। সুন্দরবনে সচরাচর বাঘের দেখা না মিললেও মাঝে মাঝে বাঘের পদচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। আর যদি সত্যিই ভাগ্য ভালো থাকে, তবে বাঘেরও দেখা পাওয়া যেতে পারে।

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা। জীবিকা নির্বাহে ২০১৮ সালের আগে তাদের বড় আতঙ্ক ছিল জল ও বনদস্যুদের উৎপাত। প্রায় দশ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার অংশ বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় পড়েছে। বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড ও ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়। এই বিচিত্র প্রাণ সম্ভারের বড় স্বাতন্ত্র্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একক জায়গা হিসেবে সুন্দরবনেই একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাঘ ছিল।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন জলদস্যুমুক্ত হওয়ার পর থেকেই বাঘ ও হরিণের আনাগোনা বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। বন দস্যুমুক্ত হওয়ায় কয়েক বছর ধরে অবাধে চলাফেরা করতে পারছে বন্যপ্রাণীগুলো। আগে অনেকে হরিণ শিকার করলেও এখন তা অনেকটা কমে গেছে। হরিণ শিকারের ফাঁদে অনেক সময় বাঘও আটকে যেতো। এতে বাঘের বিস্তারও কমে গিয়েছিল। তবে সেইসব দিন এখন অতীত।

বন বিভাগ বলছে, বাঘসহ বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় সুন্দরবনে টহল জোরদার করা হয়েছে। আগে মাঝে মাঝেই বাঘ ও হরিণ শিকার হতো বলে আমরা খবর পেতাম। আগের তুলনায় এখন বাঘ ও হরিণ শিকার নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছরে লোকালয়ে চলে আসা বাঘের মৃত্যুও কমেছে। পাশাপাশি চোরা-শিকারির উৎপাতও নেই এখন। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন সংশোধন করে সরকার বাঘ হত্যার শাস্তি ও অর্থদণ্ড বাড়িয়েছে। সুন্দরবনে বাঘের মতো যেসব প্রাণী শিকার করে বেঁচে থাকে, তাদের মধ্যে চিত্রা হরিণ, শূকর ও বানর অন্যতম। এসব প্রাণীর সংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে।

বন বিভাগের তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালের জরিপে পাওয়া যায় ৪২৫টি এবং এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়।

১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানিয়েছিল বন বিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানানো হয়। ১৯৯৬-৯৭ সালে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হতো। ২০০৪ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০টি।

২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টি। হঠাৎ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০টি থেকে ১০৬টিতে এসে দাঁড়ালে সারাবিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায়।

এই অবস্থায় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুন্দরবনে চোরা-শিকারী ও বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে এই বন্যপ্রাণীটি। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এ অবস্থায় হারিয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ২০৭০ সালে বাংলাদেশে বাঘের জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা থাকবে না। তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধিসহ উল্লেখযোগ্য জলবায়ু পরিবর্তন সুন্দরবনে টিকে থাকা কয়েকশ বাঘ বিলীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

তবে ২০১৯ সালের ২২ মে সর্বশেষ বাঘ জরিপ অনুসারে, সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ রয়েছে। সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাকিং জরিপের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করে বন বিভাগ। তাদের দাবি, বিগত সময়ের তুলনায় বর্তমানে চোরা-শিকারীদের দৌরাত্ম্য কমে আসায় সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের সংখ্যা বেড়েছে।

সুন্দরবনের কটকায় বন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মান্নান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলা, সিডর ও জলোচ্ছ্বাসের পর আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে সুন্দরবন। পাশাপাশি দস্যুমুক্ত হওয়ায় বনের প্রায় সব জীবজন্তুর সংখ্যা বাড়ছে।

জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৬ সাল থেকে সুন্দরবনের দস্যুরা একে একে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য, ৪৬২টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবন’ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও র‌্যাবের কর্মতৎপরতায় দস্যুমুক্ত হয় সুন্দরবন। মূলত এরপর থেকেই সুন্দরবনে বাঘ, হরিণ, বন্য শূকর, বানরসহ অন্যান্য প্রাণী বাড়তে শুরু করে। এসব প্রাণী এখন সুন্দরবনে অবাধে চলাফেরা করতে পারে। এতে করে তাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে।

বাঘ ও হরিণ বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুন্দরবনকে শান্তির জনপদে রূপান্তরে অনন্য ভূমিকা রাখা সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম বলেন, সুন্দরবনে দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য, ৪৬২টি অস্ত্র ও সাড়ে ২২ হাজার গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। এত অবৈধ অস্ত্র-গুলি প্রকৃতির জন্য ও বন্যপ্রাণীর জন্যও হুমকিস্বরূপ। আমার জানা মতে, তিন থেকে সাতটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে বনদস্যুদের গুলিতে। এছাড়া সুন্দরবন থেকে বাঘ শিকারীরা দস্যুদের কাছে পৌঁছাতো। এরপর দস্যুদের টাকার বিনিময়ে অর্ডারের মাধ্যমে বাঘ শিকার করা হতো এবং দস্যুদের সঙ্গে থেকে চোরা-শিকারীরা এই কাজটি করতো। এখন শিকারীদের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থানে সরকার। একেবারে জিরো টলারেন্স। সবকিছু মিলিয়ে সুন্দরবনে বাঘ-হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের জেলে ও বনজীবীদের ধারণা—বাঘের আনাগোনা আগের চাইতে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থেই বেড়েছে কি না তা আগামী বাঘ শুমারিতে জানা যাবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বলেন, বাঘের সংখ্যা যতটুকু বেড়েছে বলা হচ্ছে, সেই অর্থে বাড়েনি। আমি বলতে চাই, সেটা স্থিতাবস্থায় রয়েছে। তবে জলদস্যুমুক্ত হয়েছে এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। এটি যদি বজায় থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। যেগুলো সাধারণত চোরা-শিকারীদের হাতে মারা যেতো সেসব জীবজন্তু, বাঘ কিংবা হরিণের সংখ্যা বাড়বে।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে আগে অনেক গোলাগুলির আওয়াজ ছিল, শক্তিশালী স্পিডবোটের আওয়াজ ছিল। কিন্তু এখন এসব আওয়াজ আর নেই। জলদস্যুরা হরিণ শিকার করতে গিয়ে ফাঁদ তৈরি করতো। ওই ফাঁদে হরিণ ছাড়া বাঘও আটকে যেতো। এভাবে অনেক সময় জলদস্যুরাও বাঘ শিকার করেছে।

তিনি বলেন, বন বিভাগের নেতৃত্বে ইউএসএআইডির অর্থায়নে আমরা ২০১৪ সালে বাঘ প্রকল্প করেছিলাম, সেটা ২০১৮ সালে শেষ হয়। প্রকল্পটি বাঘ গবেষণা, সংরক্ষণ ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সচেতনতা তৈরির কাজটি এখনো চলমান। প্রকল্পটির পরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, মিডিয়া ও মানুষের ভেতর এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়। আমাদের টাইগার রেসপন্স টিম রয়েছে। বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার ৩৯টি গ্রামের ৩৪০ জন এই টিমের সদস্য। আমরা ২০১৪ সালে দেশব্যাপী সচেতনতা তৈরি করতে ব্যাপক ক্যাম্পেইন করেছিলাম। তখন বাসকে বাঘের মতো তৈরি করে আমরাই সারাদেশে ঘুরিয়েছিলাম। এমনকি আমরাই সুন্দরবনে প্রথম স্মার্ট পেট্রলিং করেছিলাম। স্মার্ট পেট্রলিংয়ের পর বিশাল সফলতা এসেছে।

সুন্দরবনের চারপাশে সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী বলেন, এর ফলে সুন্দরবনের চারপাশের মানুষের মাঝে আস্থা তৈরি হয়। এরপর থেকে বহু বছর গ্রামে বাঘ এলে মানুষ তাদের ডিস্টার্ব করে না এবং বাঘগুলো আবার ফিরে যায়। কারণ বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট একত্রে কাজ করে বাঘগুলোকে ফিরিয়ে দেয়। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, তিন বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে আটটি। তবে আমরা বলছি না সুন্দরবনে অনেক বাঘ বেড়েছে। তিন বছরে বাঘের যে সংখ্যা ছিল তা কমেনি, এটিই সবচেয়ে বড় অর্জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, বাঘ সংরক্ষণে বন বিভাগের একার পক্ষে এত বড় দায়িত্বপালন করা অসম্ভব। বাঘ সংরক্ষণে আমরা সেই কাজটি করেছি— জনগণকে সম্পৃক্ত করেছি। জলদস্যু শতভাগ নির্মূল করা গেছে কি না জানি না। তবে দস্যুদের আতঙ্ক কমেছে সুন্দরবনে।

সূত্র: জাগো নিউজ