শিরোনাম
হত্যাকাণ্ডের শিকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী জুয়েল রানার (২৯) গায়ে থাকা টি-শার্টের স্লোগানের সূত্র ধরে খুনের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ। পরে এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সূত্র: জাগো নিউজ
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পুলিশ জানায়, টোব্যাকো কোম্পানি মালবোরোর বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করায় মো. জুয়েল রানার সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা থাকতো। তারই পূর্বপরিচিতি একটি দুধ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. মিরাজের হঠাৎ টাকার বিশেষ প্রয়োজন হয়। তিনি জানতেন জুয়েলের কাছে নগদ টাকা আছে। সেই টাকা হাতিয়ে নিতেই মিরাজ দুই সহযোগীকে নিয়ে জুয়েলকে হত্যা করেন।
মিরাজ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মো. রাসেল (১৯) ও আরেকজনকে (অপ্রাপ্ত বয়স্ক- বয়স ১৫) সঙ্গে নেন। তারা প্রথমে গাবতলীতে দুধ বহনকারী কাভার্ডভ্যানে উঠে তিন দফায় ইয়াবা সেবন করেন। এরপর রাত ১০টার দিকে জুয়েলকে ডেকে কাভার্ডভ্যানে উঠিয়ে ইয়াবা সেবন করান। এক পর্যায়ে মুখ চেপে ও রশি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে জুয়েলকে শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর তারা সেই কাভার্ডভ্যানেই আগে থেকে কেনা ড্রামে জুয়েলের মরদেহ ভরে গাবতলী থেকে মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন। এই সময়ে দুধের ডেলিভারিও দেন মিরাজ। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর লাভ রোডের পাশে রাস্তায় জুয়েলের লাশভর্তি ড্রাম ফেলে পালিয়ে যান।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাত আনুমানিক ২টার দিকে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। উপস্থিত হন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ। পরে নিহতে গায়ে থাকা ‘সাফল্যের পথে একসাথে’ লেখা টি-শার্টের সূত্র ধরে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত ও খুনিদের শনাক্ত করে পুলিশ। তদন্তের এক পর্যায়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিন যুবককে গ্রেফতার করে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ।
রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) মিরপুর বিভাগ পুলিশের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন উপ-কমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহতাব উদ্দিন।
তিনি বলেন, লাশ উদ্ধারের পর আমরা নিহতের ফিঙ্গার প্রিন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তবে নিহতের গায়ে থাকা টি-শার্টের ‘সাফল্যের পথে একসাথে’ লেখা দেখে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, ওই স্লোগান সম্বলিত টি-শার্টটি একটি টোবাকো কোম্পানির। মালবোরো নামে ওই সিগারেট কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও নিহতের ছবি দেখিয়ে জানা যায়, নিহতের নাম মো. জুয়েল রানা। তার বাড়ি ভোলা সদরে। পরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবি দেখালে তারাও পরিচয় নিশ্চিত করেন।
এরপর নিহতের স্ত্রী মোসা. সালমা আক্তার (২২) পুলিশের খবরে ঢাকা এসে মিরপুর মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছিলেন মিরপুর মডেল থানার এসআই (নিরস্ত্র) মো. খোকন মিয়া। তদন্তভার গ্রহণ করে তিনি ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এরপর জড়িতদের নাম-পরিচয় শনাক্ত ও গ্রেফতারে অভিযান চালান।
এরই এক পর্যায়ে শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাত আড়াইটার দিকে দারুস সালাম থানাধীন গৈদারটেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনায় জড়িত ও তদন্তে শনাক্ত মিরাজকে (১৮) গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার মিরাজ রাজবাড়ীর কালুখালীর মো. রওশন মণ্ডলের ছেলে। অভিযানকালে তার কাছ থেকে নিহত জুয়েল রানার হেফাজত থেকে নেওয়া মালবোরো কোম্পানির সিগারেট বিক্রয়লব্ধ নগদ ৩৮ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
পরে জিজ্ঞাসাবাদে মিরাজের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মিরপুর সেকশন-২ এর এফ ব্লকের ১ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাসা থেকে হত্যায় ব্যবহৃত সিলভার রংয়ের কাভার্ডভ্যান, জুয়েল রানার ছবি সম্বলিত মালবোরো সিগারেট কোম্পানির আইডিকার্ড, চার কার্টন মালবোরো সিগারেট জব্দ করা হয়। পরে পল্লবী থানার সেকশন-১১ কাঁচাবাজার এলাকা থেকে হত্যার ঘটনায় জড়িত অপ্রাপ্তবয়স্ক একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে মালবোরো কোম্পানির সিগারেট বিক্রয়লব্ধ নগদ সাত হাজার টাকা ও ভিভো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
তাদের দুজনের দেওয়া তথ্যমতে, একই এলাকা থেকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মো. রাসেলকে (২০) গ্রেফতার করা হয়। তিনি বরিশাল হিজলার কায়েসমা এলাকার আব্দুল সত্তারের ছেলে।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে মিরপুর বিভাগ পুলিশের উপ-কমিশনার মাহতাব উদ্দিন বলেন, টাকার বিশেষ প্রয়োজন ছিল মিরাজের। তিনি টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে রাসেলকে জানান। মূলত রাসেলের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় জুয়েলকে হত্যার ছক কষেন তারা।
শুধু টাকার জন্যই কি জুয়েল হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নাকি মাদককেন্দ্রিক তাদের দ্বন্দ্ব ছিল জানতে চাইলে ডিসি মাহতাব বলেন, মালবোরো সিগারেট কোম্পনিতে বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করায় জুয়েলের কাছে বিক্রয় বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা মজুত থাকে এটা জানতেন মিরাজ। মূলত তিনজন মিলে ওই টাকাটা হাতিয়ে নিতেই হত্যার পরিকল্পনা করেন।
রাসেলের পরিকল্পনা মোতাবেক তারা প্রথমে ড্রাম কেনেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে গাবতলীতে জুয়েলকে আসতে বলেন। জুয়েল ঘটনাস্থলে আসলে তিনজন মিলে ইয়াবা সেবন করেন। তিন দফা ইয়াবা সেবনের একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন রাসেলও। তিনজন মিলে কাভার্ডভ্যানের ভেতরে বসে পেছন থেকে রশি দিয়ে জুয়েলকে গলাসহ নাকমুখ পেচিয়ে ফেলেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মিরাজ পা-মুখ চেপে ও শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে নিহত জুয়েলের কাছে থাকা মালবোরো কোম্পানির মালামাল, বিক্রয়লব্ধ ৭৬ হাজার টাকা ভাগ করে নেন তারা।
জানতে চাইলে মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মাহবুবুর রহমান বলেন, হত্যায় জড়িত তিনজনই ওই কাভার্ডভ্যানের ভেতরে থাকা ড্রামে জুয়েলের মরদেহ ঢুকিয়ে দুধ আর সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে নিরাপদে লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য পুরো মিরপুর ঘুরতে থাকেন। এ সময় মিরাজ তার দুধ কোম্পানির দুধও ডেলিভারি দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা মিরপুর সেকশন-১১ থেকে কাভার্ডভ্যানসহ লাভ রোডের মুখে রাস্তার উপরে জুয়েলের লাশভর্তি ড্রামটি ফেলে পালিয়ে যান।