জিসান হত্যা: বড় ভাই সেজে দৃশ্যপটে এসেছিল খুনিচক্র

ফানাম নিউজ
  ১১ নভেম্বর ২০২১, ১৩:৩১

রাজধানীর আব্দুল্লাহপুরে কলেজছাত্র জিসান হাবিব হত্যার এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে সংঘবদ্ধ একটি ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহপুরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান নেয়। তখন বাসে বসে মোবাইলে কথা বলছিলেন নোয়াখালীর খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জিসান। হঠাৎ বাসের জানালা দিয়ে তার মোবাইলটি টান মেরে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারী।

এসময় জিসান সঙ্গে থাকা আত্মীয় রুহুল আমিনকে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেন। পরে সেখানে আরও এক ছিনতাইকারী হাজির হয়। দুজন মিলে জিসান ও রুহুলকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। এসময় চক্রের অন্য সদস্যরা তাদের ‘বড় ভাই সেজে’ ঘটনাস্থলে হাজির হয় এবং জড়ো হওয়া লোকজন ও পথচারীদের সরিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে তারাও পালিয়ে যায়। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জিসানকে মৃত ঘোষণা করেন।

প্রায় ১১ মাস আগে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের মামলার অভিযোগপত্রে এমন তথ্যই তুলে ধরেছে পুলিশ।

জিসান হত্যা মামলার তদন্ত শেষে গত ১ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মুনজুর আলম আদালতে সাত আসামির বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩৯৬ ধারায় অভিযোগপত্র দেন। এ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড, অথবা যাবজীবন কারাদণ্ড, অথবা দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং তদুপোরি অর্থদণ্ডও হতে পারে।

মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখিত সাত আসামি হলেন- বিপ্লব ওরফে বিপ্লব ডাকুয়া ওরফে কালিদাস ডাকুয়া, সুমন ওরফে সুন্দরী সুমন, জাহাঙ্গীর বেপারি ওরফে হৃদয়, মো. রাকিব, মো. জিহাদ মিয়া, কবির মিয়া ও সোহাগ মোল্লা ওরফে নাতি সোহাগ। এর মধ্যে কবির মিয়া ও সোহাগ মোল্লা পলাতক।

এ সাতজন ছাড়াও অভিযোগপত্রে নাম আসা আসামিদের মধ্যে দুজন বয়সে কিশোর হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩৯৬ ধারায় দোষীপত্র দাখিল করা হয়। এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামি মো. স্বপন ও মো. নুরুল ইসলাম ওরফে রাব্বি শিকদারকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।

আগামী ২৮ নভেম্বর মামলার বাদীর উপস্থিতিতে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তা মুনজুর আলম বলেন, জিসান (১৮) নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বিহেরগাঁও গ্রামের সৌদি প্রবাসী আবুল বাসারের ছেলে। স্থানীয় খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র জিসান গত ২৮ নভেম্বর ধামরাইয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জিসান এক আত্মীয়কে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে যান। সেখান থেকে রুহুল আমিন নামের এক আত্মীয়ের সঙ্গে ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসে করে নবীনগর ফিরছিলেন। তাদের বাসটি আবদুল্লাহপুর এলাকায় এলে জানালা দিয়ে এক ছিনতাইকারী জিসানের মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে।

তখন বাস থেকে নেমে দৌড়ে ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেন জিসান। এ সময় রুহুলও বাস থেকে নেমে সেখানে যান। তারা দুজন ছিনতাইকারীর কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করতে গেলে পেছন থেকে অপর দুইজন ছিনতাইকারী এসে জিসান ও রুহুলকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে দুজনকে উদ্ধার করে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জিসানকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাংলা মদ ও বিয়ার খেয়ে ছিনতাইয়ে নামে তারা

আসামিরা উত্তরা আব্দুল্লাহপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুপাশে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছিনতাই করতো এবং বিভিন্ন গাড়ি থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিতো।

ঘটনার দিন ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে আসামি সুমন ও কবির টঙ্গী ব্যাংকের মাঠ বস্তিতে আসামি বিপ্লবের কাছে যায়। পরে কবির ব্যাংকের মাঠে চায়ের দোকানে সুমনকে বসিয়ে বিপ্লবের বাসায় যায়। তাদের আসতে দেরি হওয়ায় সুমনও বিপ্লবের বাসায় যায় এবং সেখানে গিয়ে বিপ্লবের সম্বন্ধী ফিরোজকেও দেখতে পায়। বিপ্লব তার বউয়ের কাছ থেকে বাংলা মদ কেনার জন্য দুই হাজার টাকা নেয়। টাকা নিয়ে বিপ্লব, কবির, ফিরোজ ও সুমন টঙ্গী রেললাইন পার হয়ে পাশের বস্তিতে গিয়ে বাংলা মদ কিনে খায়৷ সেখান থেকে ফিরোজ তার বাড়িতে চলে যায় এবং বাকি তিনজন মেঘনা রোড দিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে উঠে। সেখানে আসামিরা একটি ছিনতাই সংঘটিত করে কামারপাড়া ব্রিজ পার হয়ে আইইউবিএটি ইউনিভার্সিটির ঢালে চলে আসে।

সেখানে এসে তাদের দেখা হয় আসামি নেহাল, হৃদয়, তৈয়ব ও রাকিবদের সঙ্গে। পরে সবাই দুটি অটোরিকশা নিয়ে ১৩নং সেক্টরের কিং ফিশার বারে যায়। সেখান থেকে তিনটা বিয়ার নেয়। একটা বিয়ার বিপ্লব একাই খায়। একটা বিয়ার সুমন ও কবির মিলে খায়। আরেকটা বিয়ার হৃদয়, রাকিব, নেহাল ও তৈয়ব মিলে খায়। পরে সেখান থেকে আসামিরা হাউজবিল্ডিং দিয়ে পায়ে হেঁটে আব্দুল্লাহপুর যায়। সেখানে গিয়ে আসামি জিহাদ ও নাতি সোহাগ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। তখনই ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে আসামিরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ছিনতাইয়ের পর বড় ভাইয়ের অভিনয়

একটি লোকাল বাস আব্দুল্লাহপুর সোহাগ কাউন্টারের সামনে এলে আসামি হৃদয়, কবিরকে গাড়ির জানালা বরাবর উঁচু করে ধরে। তখন কবির গাড়ির ভেতর থেকে একটি মোবাইল টান দিয়ে দৌড় দেয়। ওই মোবাইলটিই জিসান হাবিবের। এসময় তার সঙ্গে থাকা আত্মীয় রুহুল আমিনকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে কবিরকে ধরে ফেলে। তখন বিপ্লব এসে কবিরকে ছেড়ে দিতে বললে মোবাইলের মালিক জিসান হাবিব, বিপ্লবকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। বিপ্লব উঠে এসে তার কাছে থাকা সুইচ গিয়ার চাকু বের করে জিসানকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। অন্যদিকে সঙ্গে থাকা কাটার দিয়ে কবির প্রথমে ভিকটিম রুহুল আমিনকে কয়েকটি পোচ দিয়ে জখম করে।

পরে জিসানকে কাটার দিয়ে পেছন দিক থেকে পোচ মারে। এসময় আসামি সুমন ওরফে সুন্দরী সুমন জিসানকে ইট দিয়ে আঘাত করে এবং বিপ্লব ও কবির এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। অন্য আসামিদের মধ্যে নেহাল ও ধবলা রাস্তায় পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য রাখতে থাকে। পুলিশ আসার আগেই তারা অন্য আসামিদের সংকেত দেয়। জিহাদ, রাকিব ও নাতি সোহাগ ঘটনার সময় বড় ভাইয়ের অভিনয় করে। অভিনয় করে ঘটনাস্থলের আশেপাশের লোকজন ও পথচারীদের তাড়িয়ে দেয়।

রক্ত ধুয়ে ফেলে ছিনতাইকারিরা ফিরে যায়

ভিকটিম জিসানকে মৃতপ্রায় অবস্থায় মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে আসামিরা দ্রুত ০৯নং সেক্টরের ০৭নং রোড দিয়ে ১২নং রোডের মাথা হয়ে সুইচ গেইট যায়। সেখান রাস্তার পাশে একটি চৌকিতে বসে পানি দিয়ে বিপ্লব তার জ্যাকেটে লেগে থাকা রক্ত এবং তার হাতের সুইচ গিয়ার চাকুতে থাকা রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করে। হৃদয়ও হাতের রক্ত ধুয়ে ফেলে। সেখানে আসামিরা কিছু সময় অবস্থান করে। এরপর সুমন, হৃদয় ও নাতি সোহাগ ৯নং সেক্টরে যায় এবং অন্যরা যে যার মতো বাড়ি ফিরে।

জিসান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার মামাতো ভাই মোশারফ হোসেন সৈকত বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন।

বাদী মোশারফ বলেন, জিসান হত্যার পর থেকে তার মা এখনও শোক কাটাতে পারেননি। ছেলে হারানোর পর স্ট্রোক করেছেন। তাকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। যেহেতু আসামিরা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করেছে, তাই সব আসামির ফাঁসি চাই আমরা।

সূত্র: জাগো নিউজ