দেশেই উৎপাদন হবে উটপাখি, মাংস মিলবে গরুর সমান

ফানাম নিউজ
  ২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৯:১৪

দেশে নিরাপদ আমিষের চাহিদা পূরণে গরু-ছাগল-মুরগির পাশাপাশি উটপাখিতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন গবেষকরা। উটপাখির মাংস হালাল। লালন-পালন খরচও কম। পোল্ট্রির চেয়ে এরা তিনগুণ বেশি বাড়ে। একটি উটপাখি থেকে দেড়শ কেজির বেশি মাংস পাওয়া যায়, যা দুটি দেশি গরুর সমান। তাই দেশে এই পাখি বাণিজ্যিকভাবে পালন করা গেলে আমিষের চাহিদা অনেকটা পূরণ করা সম্ভব।

আমিষের এ গুরুত্বপূর্ণ উৎস শক্তিশালী করতে ও বাণিজ্যিকভাবে উটপাখি পালন সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে গবেষণা করছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআইএ)। ২০২৫ সালের মধ্যে উটপাখি পালন সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ চলছে।

জানা যায়, পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্পের আওতায় উটপাখি নিয়ে গবেষণা চলছে। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়েছে, যা শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা ১৫টি উটপাখি লালন-পালন শুরু করে সাভারের বিএলআরআই। সবশেষ গত দুই মাস আগে আরও কিছু উটপাখি আনা হয়।

পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় উটপাখি। তবে এরা উড়তে পারে না। এদের উচ্চতা হয় সাত থেকে আট ফুট পর্যন্ত। ওজন ১৫০ থেকে ১৮০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। তৃণভোজী এ পাখিটি ঘাস ও লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। ফলে কম খরচে খামারিদের জন্য এই পাখি পালন অনেকটা সহজ।

প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, পোল্ট্রিতে মুরগি, হাঁস, কোয়েল, রাজহাঁস, কবুতর, তিতির, টার্কি, উটপাখিসহ প্রায় ১১টি প্রজাতি রয়েছে। আমাদের গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে হয়। সামনের সময়গুলোর কথা চিন্তা করে বিএলআরআই বিভিন্ন গবেষণার কার্যক্রম হাতে নেয়।

তারা বলছেন, এরই মধ্যে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। চলতি বছর থেকে ডিম উৎপাদনেও স্বয়সম্পূর্ণ। দেশে প্রত্যেকের দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংস খাওয়া প্রয়োজন, সেখানে গড়ে ১২৬ গ্রাম করে পাচ্ছে দেশের মানুষ। ডিমের ক্ষেত্রে বছরে ১০৪টি ন্যূনতম চাহিদা থাকলেও ২০২০-২১ এর তথ্য অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষ গড়ে ১২১টি ডিম খাচ্ছেন। অর্থাৎ ডিমেও কিন্তু আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।

‘কিন্তু উন্নত বিশ্বের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখা যায়, তারা বছরে গড়ে ২২০টি ডিম খান। কোনো কোনো দেশে তার চেয়েও বেশি হয়। জাপানের মানুষ গড়ে ৩০০টির বেশি ডিম খান। পুষ্টিবিদরা বলছেন, একজন মানুষের শরীরভিত্তিক কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য বছরে ১৮০টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। তাই মেধাবিকাশের জন্য আরও নিরাপদ আমিষের জোগান দিতে হবে। উটপাখির মাংস এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।’

ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন বলছে, উটপাখির মাংস হার্টের জন্য ভালো। কারণ এখানে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম। একই সঙ্গে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি। তার মানে এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডকে কিন্তু ব্রেন ফুড বলা হয়। সেজন্য এই মাংসের উপযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। বিশ্বে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই রোগীদের জন্য আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন এই মাংসের কথা বলছে।

গবেষকরা বলছেন, উটপাখির মাংসের গুণাগুণ ভালো, স্বাস্থ্যসম্মত। এটি হালাল মিট, আরেকটি বিষয় হচ্ছে এটি তৃণভোজী প্রাণী। এর একটি ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। উটপাখি ব্রয়লার মুরগির চেয়ে প্রায় তিনগুণ দ্রুত বাড়ে। উটপাখির মাংস দেশে আমিষের চাহিদা পূরণের বেশ ভালো একটি অনুষঙ্গ হতে পারে। এই মাংস বিভিন্ন দিক থেকে স্বাস্থ্যসম্মত। রেডমিট (লাল মাংস) বলা যায়। রেডমিট বলা হয় মূলত আয়রনের কারণে। এই আয়রন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষ করে অ্যানেমিয়া বা রক্তস্বল্পতা রোধে প্রয়োজন।

২০২৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে পাইলটিং আকারে প্রশিক্ষিত মডেল খামারিদের মাধ্যমে উটপাখি পালন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বিএলআরআইএ’র। যেহেতু এটি একটি বিদেশি পাখি, তাই এই মুহূর্তে এটি খামারি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে চাষের জন্য উৎসাহী করা হচ্ছে না।

গবেষকরা জানিয়েছেন, উটপাখির বাণিজ্যিক উৎপাদনে আমরা কিছুটা সময় নিচ্ছি। আগামী বছর হয়তো আমরা একটা ম্যাচিউর্ড (শক্ত ভিত্তি) পর্যায়ে যাবো। এই মুহূর্তে খামারি পর্যায়ে চাষের জন্য আমরা রিকমান্ড (সুপারিশ) করছি না। কোন ধরনের টিকা দেওয়া দরকার, কোন ধরনের খাদ্য-উপাদান প্রযোজ্য, সেটি নিয়ে গবেষণা চলছে। উটপাখির হাব বলা হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এছাড়া সার্কভুক্ত পার্শ্ববর্তী দেশে কিংবা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে উটপাখি পালন হচ্ছে। সেগুলোও পর্যবেক্ষণে রাখছেন গবেষকরা।

তারা জানান, উটপাখি আড়াই বছর পর ডিম দেয়। সেই হিসেবে আমাদের কাছে যেসব উটপাখি রয়েছে সেগুলো আগামী বছরের শেষের দিকে ডিম দেবে। অন্য দেশের মতো খামারিদের আগে প্রশিক্ষিত করে সারাদেশে বিভাগীয় পর্যায়ে যারা এ ধরনের পোল্ট্রি খামারি আছেন তাদের মধ্যে এই উটপাখি পালন ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এতে বিভিন্ন অঞ্চলের ভোক্তারা এ মাংসের স্বাদটা নিতে পারবে। এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যেই উটপাখির গবেষণার কাজটি একটি পর্যায়ে চলে যাবে। ২০২৫ সালে বিভিন্ন অঞ্চলে পাইলটিং আকারে প্রশিক্ষিত মডেল খামারিদের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে দেওয়া হবে। গবেষণার ফলাফল থেকে টেকসই কোনো প্রযুক্তি হাতে এলে তা খামারিদের ম্যানুয়ালসহ লালন-পালনের সবকিছুই বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

চড়া দামের কারণে দেশে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো গরু-খাসির মাংস কিনতে পারে না। অনেক সময় মধ্যম আয়ের চাকরিজীবীদের পাতে ওঠে না এসব মাংস। সম্ভাবনাময় উটপাখির মাংসের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে কি না সেটি নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

উটপাখি নিয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উটপাখির মাংসের স্বাদ খাসি ও গরুর মাংসের কাছাকাছি। খাসির মাংস যে দামে পাওয়া যাচ্ছে, গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন হলে ও খামারিরা এগিয়ে এলে সেসব মাংসের মতো উটপাখির মাংসও পাওয়া যাবে। তবে এই মুহূর্তে মাংসের দাম বলা যাচ্ছে না। সেটা নির্ভর করবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর পর। তবে উটপাখির মাংস মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে।

দুই মাস আগে কয়েকটি ছোট উটপাখি আফ্রিকা থেকে আনা হয়, যার প্রতিটির দাম ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু এর আগে আনা উটপাখিগুলো বড় হয়ে গেছে। সেগুলোর বাজারমূল্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েক লাখ টাকা। সহজলভ্য না হওয়া কিছু কিছু জায়গায় উটপাখির মাংস এখনো দেড় থেকে দুই হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। একটি উটপাখি থেকে প্রায় ২-৩টি দেশি গরুর সমান মাংস মিলবে।

বিএলআরআইএ’র কর্মকর্তারা জানান, নিরাপদ আমিষের জোগান দিতে অনেক ক্ষেত্রেই পোল্ট্রির মাংস খাচ্ছে মানুষ। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগির মাংস মোটামুটি সহজলভ্য, যা অনেক আমিষের জোগান দিয়ে আসছে। কিন্তু এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে, রুচিবোধের পরিবর্তন হচ্ছে এবং মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে এ প্রকল্পের গবেষণা চলছে।

এখানে একজন পিএইচডি ফেলো আছেন, তিনি হাজী মুহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গবেষণা করছেন। আমরা দেখতে চাই প্রাথমিকভাবে এই উটপাখির যে তথ্য-উপাত্ত সেটা আমাদের পরিবেশে কেমন ঠিক থাকে। এর মাংস উৎপাদন কেমন, মাংসের গুণাগুণ কেমন। কিংবা এ থেকে বাচ্চা উৎপাদন করে আমাদের এই আবহাওয়ায় লালন-পালনের সুযোগ ও সম্ভাবনা কতটুকু। একে কী কী ধরনের খাদ্য সরবরাহ করা উচিত।

বিএলআরআইয়ের এ প্রকল্পের পরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার বলেন, প্রথমে গবেষণার জন্য ১৫টি উটপাখি আনা হয়। বিভিন্ন সময় এর মাংসের গুণাগুণ, বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের টেস্টের জন্য কোন সময়ে এদের মাংসের গুণগত মান ভালো সেটি দেখার জন্য গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করছি। সম্প্রতি দুই মাস আগে আরও কিছু ছোট উটপাখি নিয়ে এসেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেহেতু এদেশে পাখিটি পাওয়া যায় না, কাজেই মুরগি কিংবা হাঁসের বাচ্চার মতো আমি ইচ্ছা করলেই এটা নিতে পারি না। এই গবেষণার ফলাফলটার জন্য বেশি রিপ্রেজেন্টেটিভ হলে ভালো হতো। কিন্তু আমরা এখান থেকেই পালন পদ্ধতি, ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতাটা নিচ্ছি।

তিনি বলেন, এর ওপর ভিত্তি করেই পরে বৃহৎ আকারে এটা লালন-পালনে যাবো। একটা সময় গবেষণার মধ্য থেকেই কিছু সিস্টেম চলে আসবে। যেমন- নিজস্ব হ্যাচারিতেই উটপাখির ডিমটা ফোটানোর ব্যবস্থা করবো। তাহলে পরনির্ভরশীলতার যে বিষয়টি সেটি কমিয়ে আনতে পারবো। একবারে হয়তো সম্ভব হবে না। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা প্রতিবেশী দেশ। তাদের সঙ্গে আমাদের কালচারসহ অনেক কিছুতেই মিল আছে। তারা কীভাবে খামারগুলো ডেভেলপ করছে সে বিষয়ে আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই।

তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে শখের বশে খুলনা, নরসিংদী, গাজীপুরসহ কয়েকটি জায়গায় অনেকে উটপাখি পালন করছেন। ২০২৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে পাইলটিং আকারে প্রশিক্ষিত মডেল খামারিদের মাধ্যমে উটপাখি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সারাদেশে যেসব অফিস আছে এবং খামারিরা সেবা পাচ্ছেন, সেখানে আমরা মডেল খামারি তৈরি করতে পারবো, যাতে আঞ্চলিক খামারিরা সুবিধাটা পান।

এ বিষয়ে বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. আব্দুল জলিল বলেন, উটপাখির বিষয়টি হলো তিন বছর সময় লাগে। আড়াই বছর আগে এরা ডিম দেয় না। ডিমগুলো ম্যাচিউর্ড হলে তাদের প্রোডাকশন কেমন হবে সেটা দেখে আমরা বলতে পারবো। উটপাখির গবেষণায় ২০২৫ সালে গিয়ে আমাদের পাঁচ বছর পূরণ হবে। এই পাঁচ বছরে আমরা দু’বার বাচ্চা পাবো। তাহলে আমরা বলতে পারবো এটির ওয়েট (ওজন) কতো হবে, ডেইলি কতটুকু বাড়বে, কীভাবে খাবে, ব্যবস্থাপনা কী হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা উটপাখির বাণিজ্যিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে খামারিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হস্তান্তর করতে পারবো। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রশিক্ষণসহ এটি খামারি লেভেলে ট্রান্সফারের লক্ষ্য রয়েছে।

সূত্র: জাগো নিউজ