শিরোনাম
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আপাতত প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। স্থায়ীভাবে তিনি কোথায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেবেন বা পাবেন সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। কিন্তু ভারতে কতদিন থাকতে পারবেন শেখ হাসিনা? যতদূর জানা যাচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ডিপ্লোম্যাটিক/অফিশিয়াল পাসপোর্ট এখনো বাতিল করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। আর এই পাসপোর্টের বলেই তিনি ভারতে ভিসা ছাড়া ৪৫ দিন অবস্থান করতে পারবেন, যার মধ্যে ১৫ দিন পার হয়েছে। আর এক মাস ভারতে থাকার বৈধতা রয়েছে তার।
বিবিসি বাংলার এক বিশেষ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিমান দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে ঠিক ১৫ দিন আগে। সে দিন (৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় ওই বিমানঘাঁটিতে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে স্বাগত জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।
তার পরদিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দেশটির পার্লামেন্টে জানান, ভারত সরকারের কাছে শেখ হাসিনা ‘সাময়িকভাবে’ এ দেশে আসার অনুমোদন চেয়েছিলেন এবং তা মঞ্জুর হওয়ার পরই তিনি ভারতের মাটিতে পা রেখেছেন।
তবে শেখ হাসিনা ঠিক কোন ‘ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসে’ রয়েছেন, সে ব্যাপারে জানায়নি ভারত। তিনি কি কোনো বিশেষ ভিসায় ভারতে অবস্থান করছেন, নাকি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে– সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। কিন্তু তার অবস্থানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। সেখানে তিনি কোন স্ট্যাটাসে থাকছেন এবং তার অভিবাসনগত বৈধতা কতদিন পর্যন্ত—এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠছে এখন।
এ বিষয়ে বিবিসি বাংলা দিল্লিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, শেখ হাসিনা যে ‘ডিপ্লোম্যাটিক/অফিশিয়াল’ পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন তা এখনো বৈধ রয়েছে। সেই পাসপোর্টের সুবাদে তিনি অন্তত দেড় মাস কোনো ভিসা ছাড়াই ভারতে অবস্থান করতে পারেন।
“যদি এর মধ্যে সেই পাসপোর্ট ‘রিভোকড’ বা প্রত্যাহৃত না হয়, তাহলে এই সময়সীমার মধ্যে ভারতে তার অবস্থান সম্পূর্ণ আইনসম্মত। ভারতের এ ক্ষেত্রে আলাদা করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনও নেই”–বলছেন দেশটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ রেহানার ক্ষেত্রে এই জটিলতা নেই। তিনি যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টধারী হওয়ায় অন অ্যারাইভাল ভিসায় (ভারতের মাটিতে পা রাখার পর ব্রিটিশ নাগরিকদের যে ভিসা দেওয়া হয়) যতদিন খুশি ভারতে থাকতে পারবেন।
গত ১৬ আগস্ট দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনার অবস্থানের বিষয়টি ওঠে। মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের কাছে জানতে চাওয়া হয়, প্রায় দুসপ্তাহ হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে অবতরণ করছেন। আপনি কি আমাদের বলতে পারেন তার এই অবস্থানের (ইমিগ্রেশনগত) স্ট্যাটাসটা কী... অর্থাৎ তিনি কি নিয়মিত ভিসায় এ দেশে আছেন? নাকি তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন? নাকি তাকে কোনো ধরনের গৃহবন্দি বা অন্তরীণ অবস্থায় (ডিটেনশনে) রাখা হয়েছে?
সাংবাদিক বলেন, প্রশ্নটা এই কারণেই করা, আমরা নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী সংকেত পাচ্ছি। তার কন্যা (সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) টুইট করেছেন যে তিনি মা-র সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। আবার এর পাশাপাশি, আমেরিকায় অবস্থানরত তার ছেলের (সজীব ওয়াজেদ জয়) মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিবৃতিও জারি করেছেন। ফলে শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানের প্রকৃত স্ট্যাটাস নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরির অবকাশ হচ্ছে, তার বদলে ভালো হয় যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের জানায় ঠিক কোন শর্তের অধীনে তিনি এ দেশে রয়েছেন।
যে সাংবাদিক এই প্রশ্নটি করেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু মুখপাত্র তার জবাবে প্রথমেই স্পষ্ট করে দেন, ‘আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কথা বলছি।’
রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “আমরা গত সপ্তাহেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলাম যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে আসার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছিল খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে।”
মুখপাত্র বলেন, “এই পরিস্থিতি এখনো ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে (‘ইভলভিং’)। এই মুহূর্তে অন্তত তার (শেখ হাসিনার) পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের নতুন করে কিছু জানানোর নেই।”
এর ১০ দিন আগে (৬ আগস্ট) পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, “শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর খুব অল্প সময়ের নোটিশে তখনকার মতো ভারতে আসার জন্য অনুমোদন চান। একই সঙ্গে ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্সের অনুমতিও চাওয়া হয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।”
বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করার জন্য জয়শঙ্কর সেদিনও এই ‘ইভলভিং’ বা পরিবর্তনশীল শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
শেখ হাসিনা ভারতে অফিসিয়াল পাসপোর্ট নিয়ে বিনা ভিসায় অবস্থান করছেন দু’দেশের একটি সমঝোতার ভিত্তিতে।
দিল্লিতে একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছেন, ভারতে শেখ হাসিনার এই মুহূর্তে অবস্থানের ভিত্তিটা হলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সংশোধিত ট্র্যাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট’।
২০১৮ সালের ১৫ জুলাই ঢাকায় শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
ওই সমঝোতাপত্রের ১(এ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, উভয় দেশের ডিপ্লোম্যাটিক ও অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীদের ৪৫ দিনের মেয়াদে ভিসা ছাড়াই বসবাসের জন্য (‘ভিসা ফ্রি রেজিম’) থাকতে দিতে দুই দেশ পারস্পরিকভাবে রাজি হয়েছে।
এই সমঝোতা অনুযায়ী দুদেশের ডিপ্লোম্যাটিক/অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন থাকতে পারবেন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে দেশত্যাগ করলেও তার ডিপ্লোম্যাটিক/অফিশিয়াল পাসপোর্ট এখনো বৈধ রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা বাতিল করেছে– এরকম কোনো খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় (যতদিন সেই পাসপোর্ট বহাল থাকছে) দুদেশের মধ্যেকার সমঝোতা অনুযায়ী শেখ হাসিনা টেকনিক্যালি কোনো ধরনের ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন ভারতে অবস্থান করতে পারবেন। যদিও এর মধ্যে ১৫ দিন পার হয়ে গেছে।
জানা গেছে, ডিপ্লোম্যাটিক ও অফিশিয়াল/সার্ভিস পাসপোর্টধারীরা যাতে বিনা ভিসায় একে অন্যের দেশে থাকতে পারেন, সে জন্য ১০০টি দেশের সঙ্গে ভারতের একই ধরনের সমঝোতা রয়েছে। শুধু ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারীদের জন্য অনুরূপ সমঝোতা আছে আরও ৩৪টি দেশের সঙ্গে।
ভারতে বিনা ভিসায় থাকার মেয়াদ কোনো দেশের ক্ষেত্রে ৯০ দিন, কোনো দেশে ৪৫, ৩০ কিংবা ১৪ দিন।
শেখ হাসিনার হাতে থাকা আর এক মাস সময়ের মধ্যে যদি বর্তমান পাসপোর্ট ‘রিভোক’ বা বাতিল করা হয়, তাহলে ভারত সরকার কী করবে– এ প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রেও বড় কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছে দেশটির এক কর্মকর্তা।
দিল্লিতে একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, “সেটাও বড় কোনো সমস্যা নয়। কারণ এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের ‘প্ল্যান বি’ বা ‘প্ল্যান সি’ প্রস্তুত রাখতেই হয়, এখানেও নিশ্চয়ই সেটা তৈরি আছে।”