শিরোনাম
প্রখ্যাত বাম রাজনীতিক ও লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আকবর খান রনোর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। সোমবার (১৩ মে) বিকেলে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে মা-বাবা ও ছোট ভাইয়ের পাশে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো গত শুক্রবার (১০ মে) রাতে ঢাকার পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে মারা যান।
তার মরদেহ সোমবার সকালে পুরানা পল্টনে সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুক্তি ভবনে নেওয়া হয়। সেখানে দলের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল সাড়ে ১১টায় মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। শহীদ মিনারে রনোকে গার্ড অব অনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সালাম ও সম্মান জানায় প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।
এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নেওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রনোর প্রতি গার্ড অব অনার প্রদান শেষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সর্বস্তরের মানুষ।
বাংলাদেশে বামপন্থী ধারার এই প্রবীণ রাজনীতিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সিপিবির সর্বস্তরের নেতাকর্মী ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, গণসংহতি আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ব্যক্তিত্বসহ সাধারণ মানুষ। এ সময় সকলেই এক বাক্যে মেহনতি মানুষের পক্ষ আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন রনোর অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা স্মরণ করেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল এবং নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হায়দার আকবর খান রনো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার সঙ্গে আমাদের আদর্শিক পার্থক্য হলো দার্শনিক বিষয়। জাতির পিতার আহ্বানে আমরাও মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তিনিও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি একজন তাত্ত্বিক ছিলেন। লেখনীর মাধ্যমে তিনি নিজের আদর্শকে তুলে ধরার পাশাপাশি জাতির সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।’
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে, জনগণের মুক্তিসংগ্রামে হায়দার আকবর খান রনো একটি অনন্য নাম। ছাত্রজীবন থেকে তিনি এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতি করেছেন এবং মার্কসবাদী আদর্শে দীক্ষিত এই মানুষটি সারা জীবন নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে মানুষের মুক্তির জন্য, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। তার মৃত্যুতে জাতি একজন সূর্যসন্তানকে হারাল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে জাতির বড় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি আগাগোড়া বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কোনো দিন আপস করেননি, কখনো বিচ্যুত হননি। তিনি মার্কসবাদী-লেলিনবাদী ছিলেন। ওই আদর্শের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো সুবিধাবাদিতা তার চরিত্রের ধারেকাছেও আসতে পারেনি। তিনি কৈশোরে যেভাবে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তিনি সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি করেছেন।’
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের মধ্যে যারা সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করেন, তাদের মধ্যে উনি একজন ব্যতিক্রমধর্মী নেতা ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা হাতে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা যায়, এই রাস্তাটা তিনি বলিষ্ঠতার সঙ্গে দেখিয়ে গিয়েছেন। অনেক বামপন্থী বিভ্রান্তিতে ভুগলেও, হায়দার আকবর খান রনো কখনোই বিভ্রান্তিতে ভোগেননি। বাংলাদেশের প্রশ্নে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে, স্বাধীনতা প্রশ্নে তিনি আপসহীন লড়াই করেছেন।’
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর নাম ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। প্রতিটি সংগ্রামে তিনি আপসহীন লড়াই করেছেন। তিনি দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য, জনগণের ভবিষ্যৎ রচনার জন্য চেষ্টা করেছেন। এ দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি আমাদের আদর্শের প্রতীক হয়ে থাকবেন।’