শিরোনাম
বাঙালি জাতি ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাঙালির সেই বিজয় ছিনতাই হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষক, পরাজিত পাকিস্তানি শক্তির প্রেতাত্মাদের প্রধান সমরনায়ক খুনি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিপরীতে এক পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন, মানুষের ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অন্ধকার বাংলাদেশে নবতর সংগ্রামের আলোকবর্তিকা হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক বিশেষ স্মরণীয় দিন। একইভাবে ৭ মে ২০০৭ বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে এক অবিস্মরণীয় দিন। ২০০৭ সালের ৭ মে তৎকালীন তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষিত জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা শেষে শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে তথাকথিত ১/১১ সরকার অবৈধ ও বেআইনি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় কাল্পনিক দুর্নীতি ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন খুনের অভিযোগ। এমনকি বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে ঢাকার একটি আদালত ২৮ মে ২০০৭-এর মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে তাঁর সব সম্পত্তি ক্রোক করার এক হাস্যকর আদেশ প্রদান করে। সে সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২১ আগস্টের বর্বর গ্রেনেড হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কান ও চোখের চিকিৎসা নিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন।
‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় দায়ের করা এই দুরভিসন্ধিমূলক কাল্পনিক দুর্নীতি ও হত্যা মামলা মোকাবিলা করতে তিনি তৎপর হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন তার জন্য ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি সব এয়ারলাইনসকে যাত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে বহন না করার জন্য এক বেআইনি আদেশ প্রদান করে। এই অবস্থায় তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে লন্ডন এসে ঢাকা ফিরতে তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ২০০৭ সালের ২২ এপ্রিল রবিবার লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে বিশ্বের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা বলেন, “This is my country, and I don’t understand why they should stop me. I want to face the case. This is totally fake, false. I didn’t commit any murder, so it is absolutely false case and that’s why I’m going to face it.” (The New York Times, April 23, 2007)
দিনটি ছিল ২০০৭ সালের ২২ এপ্রিল রবিবার। বিশ্ববিখ্যাত লন্ডন ম্যারাথন ইভেন্টের দিন। লন্ডন শহরে ম্যারাথনের কারণে সড়ক যোগাযোগ থাকে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। বাস চলাচল বন্ধ থাকার কারণে হাজার হাজার মানুষ অনেক কষ্ট স্বীকার করে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনের অস্বাভাবিক যাত্রীর ভিড় ও নিজ নিজ ব্যস্ততা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে হিথ্রো বিমানবন্দরে ভিড় করে। হিথ্রো বিমানবন্দরে সেদিন ব্রিটিশ গণমাধ্যমসহ বিশ্ব মিডিয়ায় তার সরব উপস্থিতি ছিল নজিরবিহীন।
আমি তখন আমার বিভিসি (Bar Vocational Course) অর্থাৎ Bar-at-Law কোর্সের সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পরের দিন ২৩ এপ্রিল ২০০৭ তারিখে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও আমরা কয়েকজন সহপাঠী মিলে দলবদ্ধভাবে হিথ্রো বিমানবন্দরে ছুটে যাই এবং সেখানে দায়িত্বরত ও পূর্ব পরিচিত বিবিসি বাংলা বিভাগের সিনিয়র সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেনের কল্যাণে খুব কাছ থেকে সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই (উল্লেখ্য, মোয়াজ্জেম ভাইয়ের বাড়ি চট্টগ্রামে এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র)। মোয়াজ্জেম ভাইকে অনুরোধ করা হলে তিনি বিবিসি লোগো সংবলিত মাইক্রোফোনটি আমার হাতে দিয়ে তাকে অনুসরণ করার জন্য বলেন। তিনি সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মীদের তার সহকারী পরিচয় দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার বহরের সঙ্গে আমাকে বিমানবন্দরের ভিতরে নিয়ে যান। যতটুকু মনে পড়ে, বিবিসি বাংলা বিভাগ ২২ ও ২৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দুটি বড় সাক্ষাৎকার প্রচার করে। আল জাজিরা টিভির বিখ্যাত সাংবাদিক স্যার ডেভিড ফ্রস্ট ২৭ এপ্রিল ২০০৭ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার প্রচার করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সব সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে ২২ এপ্রিলের হিথ্রো বিমানবন্দরের ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে প্রচার ও প্রকাশ করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অপর কন্যা শেখ রেহানা, পরিবারের সদস্য রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির এমপি Anne Main, ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা Emily Thornberry MP, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সোবহান গোলাপ, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা শামসুদ্দিন খান, প্রফেসর আবুল হাসিম, সুলতান শরীফ, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাজিদুর রহমান ফারুক, বর্তমান এমপি হাবিব ভাইসহ অনেকেই ছিলেন। বাইরে অপেক্ষারত ছিল হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা ভয় নাই, আমরা আছি লক্ষ ভাই- স্লোগানে হিথ্রো এয়ারপোর্ট প্রকম্পিত করেছিল। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বাংলাদেশ সরকারের অবৈধ নিষেধাজ্ঞার কারণে শেখ হাসিনাকে বোর্ডিং পাস দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরতে না পেরে হিথ্রো বিমানবন্দরে বিশ্বগণমাধ্যমের সামনে যেকোনও পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কয়েক দিন পর পূর্ব লন্ডনের Hackney Downs এলাকায় এক মিলনায়তনে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালির উদ্দেশে শেখ হাসিনা তৎকালীন তথাকথিত ১/১১ সরকারের বেআইনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাংলাদেশে ফিরে আসার দৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন। আমার লন্ডনের ভাড়া বাসার মালিক সত্তরোর্ধ্ব ফজলু মিয়াকে নিয়ে সেই জনসভায় কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি লন্ডনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভূতপূর্ব আবেগ ও ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
এই পটভূমিতে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেআইনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় এবং ৭ মে ২০০৭ শত শত প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সহযাত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা শেখ হাসিনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মিছিল শোভাযাত্রাসহ বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে সাজানো মামলায় গ্রেফতার করে এবং বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক নবতর সংগ্রামের সূচনা হয়।
জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্ত করতে দেশে বিদেশে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়। লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র টিউলিপ সিদ্দিক ও রাদওয়ান সিদ্দিকের নেতৃত্বে ‘Call for the release of Sheikh Hasina - the former Prime Minister of Bangladesh’ শিরোনামে এক প্রচারণা শুরু করে এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে E-Petition -এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার আশু মুক্তি দাবি করে। সেদিন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা গণস্বাক্ষর সংগ্রহে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তাদের মধ্যে ড. সেলিম মাহমুদ (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক), মহিবুল হাসান চৌধুরী (মাননীয় শিক্ষা উপ-মন্ত্রী), নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন, তানভীর, আব্দুর রহিমসহ অনেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। মনে আছে, প্রাণপ্রিয় নেত্রীর মুক্তি দাবি করে আমরা অনেকে দলবদ্ধভাবে ওয়েস্টমিনিস্টার, হোয়াইটহল এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সরাসরি এবং ই-মেইলে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলাম। ওয়ান-ইলেভেনের সময় জাতির পিতার দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ভাইয়ের একটা ব্লগ ছিল। ব্লগটির নাম ছিল ‘সজীব ওয়াজেদ জয়’। ওই সময় ড. সেলিম মাহমুদ এবং আমি ওই ব্লগে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিখতাম। ওই দিনগুলোতে প্রতিদিন অন্তত একবার ড. সেলিম মাহমুদ ও আশরাফুল আলম খোকনের (পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব) সঙ্গে আমি টেলিফোনে কথা বলতাম। ড. সেলিম তখন ডান্ডিতে পিএইচডি করছিলেন এবং আশরাফুল আলম খোকন যুক্তরাষ্ট্রে চ্যানেল আই প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন।
২০০৮ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য পুনরায় লন্ডনে যান। পূর্ব লন্ডনের Impression Events Banquette Hall-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সম্মানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ পৃথক সংবর্ধনার আয়োজন করে। মাননীয় টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক এমপি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তার মুখ থেকে সবকিছু শুনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মঞ্চে ডেকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ব্যারিস্টারি ডিগ্রি সম্পন্ন হয়েছে জেনে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসার নির্দেশনা দেন। যার কারণে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আমি বাংলাদেশে ফিরে এসে জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মিডিয়া সেলের যুগ্ম-সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। শুরু করেন সংকটের আবর্তে নিমজ্জমান দেশকে পুনরুদ্ধার করে একটি উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলার বিরামহীন সংগ্রাম। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিন বদলের অভিযাত্রায় উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।