শিরোনাম
দীর্ঘ চেষ্টার পর পূর্ব সুন্দরবনের আমরবুনিয়ায় লাগা আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। রোববার (৫ মে) ভোর ৫টা থেকে পুরোদমে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট এবং বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার আগুন নেভানোর কাজ শুরু করায় আগুনের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে তিন সদস্যের তন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বন বিভাগের পাশাপাশি নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, বন সুরক্ষা কমিটির সদস্য ও স্থানীয় লোকজন আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত হয়েছেন।
এ রিপোর্ট লেখার সময় (বিকেল সাড়ে ৪টা) ঘটনাস্থল থেকে সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো মোবাইল ফোনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘বিক্ষিপ্তভাবে মাঝে মাঝে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেলেও আগুনের ভয়াবহতা এখন আর নেই। অগ্নিকাণ্ড এলাকার প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের মরাভোলা নদীর বিভিন্ন স্থানে পাইপ বসিয়ে সেখান থেকে পানি দেওয়া হচ্ছে। বাগেরহাট, মোংলা, কচুয়া, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলাসহ ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট এই কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
এ ছাড়া বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার ওপর থেকে পানি ছিটাচ্ছে। প্রথামিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আগুনে পাঁচ থেকে ছয় একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জিপিএস ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে পরিমাপ করার পর সঠিক হিসাব জানা যাবে।’
মিহির কুমার দো আরো জানান, সম্পূর্ণভাবে আগুন নিভেছে কি না তা নিশ্চিত হতে আরো দুই-তিন দিন সময় লাগবে। বন বিভাগের সদস্যরা সার্বক্ষণিক এলাকা পর্যবেক্ষণে থাকবেন। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম ঘটনাস্থলে অবস্থান করবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হবে।
এর আগে শনিবার (৪ মে) সকাল ১১টার দিকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলাধীন পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধরা স্টেশনের আমরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
স্থানীয়দের ধারণা, প্রায় ১০ একর বনভূমিতে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাথমিকভাবে বনকর্মী এবং বন সুরক্ষায় নিয়োজিত ভিটিআরটি, ভিজিএফ, টাইগার টিমের সদস্য ও স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে অগ্নিকাণ্ড এলাকার চারদিকে ফায়ার লেন কেটে আগুনের বিস্তার রোধের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গাছের পাতা পড়ে পুরু স্তর তৈরি হওয়ায় নিচ থেকে আগুন ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
সংরক্ষিত বনে আগুন লাগার সঠিক কারণ বন বিভাগ জানাতে না পারলেও স্থানীয় বাসিন্দারের ভাষ্য, বর্তমানে সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম চলছে। এ ছাড়া বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু আহরণের মৌসুম এখন। এ কারণে বনের পাশের গ্রামগুলোর একশ্রেণির লোক গোপনে বনে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহ এবং বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে শ্যালা নদীতে পোনা আহরণ করতে যায়। এরা বিড়ি-সিগারেট খেয়ে তার অবশিষ্টাংশ বনে নিক্ষেপ করে। অপরদিকে অবৈধভাবে মধু সংগ্রহকারীরা মৌমাছি তাড়ানোর জন্য মশাল ব্যবহার করে। তা থেকেও আগুন লাগতে পারে। এই দুই শ্রেণির পেশাজীবীদের নিক্ষিপ্ত আগুনে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।
স্থানীয়রা আরো জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সুন্দরবনের বিভিন্ন বিলে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ধানসাগর ও জিউধরা স্টেশনের আওতায় এমন অসংখ্য বিল রয়েছে। এসব বিল পরিষ্কার করার জন্য শুষ্ক মৌসুমের এই সময়টাতে ওই সব অসাধু জেলেরা ইচ্ছাকৃত বনে আগুন ধরিয়ে দেয়। যাতে আগাছা পরিষ্কার হয়ে বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরতে সহজ হয় তাদের।
এদিকে ২০০২ সালের ২২ মার্চ থেকে চলতি বছরের (২০২৪) ৪ মে পর্যন্ত সুন্দরবনে ২৪ বার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনাই মানবসৃষ্ট। ভুলে, ক্ষোভে অথবা অসতর্কতায় এসব অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রতিটিরই তদন্ত কমিটি গঠন বা দু-একটি মামলা হলেও আজ পর্যন্ত কোনোটিরই রহস্যভেদ হয়নি। ফলে প্রতিবছরই এ ধরনের নাশকতা ঘটেই চলেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও কাজী মুহাম্মদ নূরুল করীম জানান, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানাদেবকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বন বিভাগ। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জিউধরা স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) মো. ওবায়দুর রহমান ও ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) মো. রবিউল ইসলাম। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে আগুন লাগার সঠিক কারণ উদ্ঘাটনসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার উপপরিচালক মামুন মাহমুদ জানান, খবর পেয়ে প্রথম দিন ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট গিয়ে শুধু পাইপ স্থাপনের কাজ করে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড এলাকা দুর্গম হওয়ায় এবং অন্ধকার নেমে আসায় কিছুই করা যায়নি। আজ (রবিবার) ভোর ৫টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের নতুন আরো দুটি ইউনিটসহ মোট পাঁচটি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। যেখানে ধোঁয়া উড়ছে সেখানেই পানি দেওয়া হচ্ছে। এখন আর তীব্রতা নেই। এ ছাড়া বিমানবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটানোয় আগুন নিয়ন্ত্রণ আরো সহজ হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম ঘটনাস্থলে অবস্থান করবে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।