শিরোনাম
বিলাসিতা ছেড়ে শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষ নজর দিতে শিল্প মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, যে শ্রমিকরা তাদের কঠোর শ্রম দিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে মালিকদের জীবন-জীবিকা উন্নত করা অথবা বিলাসবহুল জীবন যাপনের সুযোগ করে দিচ্ছে সেখানে তারা বিলাসিতা একটু কমিয়ে শ্রমিকদের দিকে বিশেষভাবে নজর দেবেন সেটাই আমি চাই।
বুধবার (১ মে) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ঐতিহাসিক মহান মে দিবসে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
কোভিড-১৯ মহামারি সময় মালিকদের প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান এবং মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কলকারখানা এবং উৎপাদন যেন অব্যাহত থাকে সেজন্য এটি তার সরকার করেছে এবং মালিকরা ধীরে ধীরে তা শোধ করছেন। কাজেই এর পেছনে সরকারের ভর্তুকি রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি বাংলাদেশে কিছু ভাড়াটে লোক কথায় কথায় শ্রমিকদের নিয়ে রাস্তায় নামার চেষ্টা করে। এখন যে কারখানা আপনাদের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করছে কাজের ব্যবস্থা করছে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করছে এই কারখানা নিজেরা যদি ধ্বংস করতে যান, ভাঙচুর করেন তাহলে ক্ষতিটা কার হবে?
শ্রমিকদের তিনি বলেন, এতে নিজের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, পরিবারের ক্ষতি হচ্ছে। তেমনই দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। মালিকদেরও ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু মালিকদের তো আর একটা ব্যবসা থাকে না, আরও অনেক ব্যবসা থাকে। তারা হয়তো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু আপনাদের নিজেদের ক্ষতি তো আপনারা নিজেরা করেন।
ধাপে ধাপে পোশাকশ্রমিক মজুরি মাত্র ৮০০ টাকা থেকে ১৬০০ এবং পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সালে তা ১২ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত করার প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির দাবির জন্য, কথা বলার জন্য আমরা তো আছি। আমরা তো বলি। আমি শুধু প্রধানমন্ত্রী নই, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি সেভাবেই নিজেকে বিবেচনা করি।
তিনি আরও বলেন,আপনাদের যদি কোনো অসুবিধা হয়, আমার দুয়ার আপনাদের জন্য সবসময় খোলা। আপনারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সেগুলো আমরা দেখবো এবং আমাদের শ্রমিক সংগঠনও রয়েছে।
শ্রমিকদের শুধু নয় কৃষক, এমনকি বর্গাচাষিদের বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের সুযোগ সরকার করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। আজকে শতকরা ৯৮ শতাংশ শিশু স্কুলে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের বৃত্তি দিচ্ছি, খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বিনামূল্যে বছরের প্রথম সপ্তাহে বই দিচ্ছি এবং কারিগরি ও ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য ব্যাপক হারে বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। এটা আগে ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর আমরা করেছি। যেন ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আমাদের বেকারের সংখ্যা ৩ শতাংশ নেমে এসেছে। যা প্রায় ২ থেকে ৩ গুণ বেশি ছিল। কর্মসংস্থান ব্যাংকের উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য যুবকদের বিনা জামানাতে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো সমস্যা হলে সেটা বলবেন, কিন্তু কারও প্ররোচনায় বা উসকানিতে নিজেদের রুটি-রুজি ও ভাত কাপড় ধ্বংস করবেন না। সেটার প্রতি আপনারা অবশ্যই যত্নবান হবেন। আর মালিকদের বলবো- আপনারা আপনাদের বিলাসিতার কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণ দেখবেন।
তিনি এ সময় ক্রেতাদের উদ্দেশে বলেন, এখন তো সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কাজেই আপনারা যদি পণ্যমূল্য কিছুটা বাড়িয়ে দেন, তাহলে আমি নিজেও মালিকদের আরও চাপ দিতে পারি আমাদের শ্রমিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। আমি আশা করি আইএলও শুধু শ্রমিক নয়, মালিকদের এ বিষয়টিও দেখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও নারীরা পুরুষের সমান মজুরি পায় না, কিন্তু বাংলাদেশে পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ৪৩ দশমিক ৪১ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ছিল মাত্র ২২ দশমিক ৮১ ভাগ। এখন মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে কাজ করতে পারছে, সে সুযোগ আমরা সৃষ্টি করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী এর আগে কয়েকটি শ্রমিক পরিবারের কাছে আর্থিক সহায়তার চেক হস্তান্তর করেন। পরে তিনি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
শেখ হাসিনা তার সরকারকে শ্রমিকবান্ধব সরকার হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তার সরকার শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও নিরাপদ কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, তাদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার ও থাকার জন্য ডরমেটরি নির্মাণ, নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনসহ সবকিছু করেছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই শ্রমিকদের আয় বেড়েছে। আমাদের দল সবসময়ই মনে করে শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করাই আমাদের কর্তব্য।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশ আইএলওর সব কনভেনশন ও প্রটোকল সই করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশ এখনো এর সবগুলোতে সই করেনি।
সরকারপ্রধান সতর্ক করে বলেন, আমরা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও বকেয়া প্রদান না করে বঞ্চিত করার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেবো না। যদি কেউ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে, তবে সে যে-ই হোক না কেন, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো ব্যক্তি হলেও আমরা তাকে কখনোই ছাড় দেবো না।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। যা বেকারত্বের হার কমিয়ে ৩ শতাংশে আনতে সাহায্য করেছে।
শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের জন্য সরকারের পদক্ষেপের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বছরের প্রথমেই কোমলমতি শিশুদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিচ্ছে। বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা বেসরকারি খাত উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমাদের বেকারত্ব ৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগে দুই বা তিনগুণ বেশি ছিল।
তিনি বলেন, সরকার কর্মসংস্থান ব্যাংক গড়ে তুলেছে। সেখান থেকে যুবকরা ব্যবসা করার জন্য গ্যারান্টি ছাড়াই ঋণ নিতে পারে।
আলোচনায় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এইচ এম ইব্রাহিম, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তুওমো পুতিয়ানেন, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি আরদাশির কবির ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি নূর কুতুব আলম মান্নান প্রমুখ অংশ নেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেন।