শিরোনাম
প্রমত্তা যমুনা নদীর গভীরতা ও স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর ভৌত অবকাঠামোর কঠিনতম কাজ নদীর তলদেশে ৫০টি পাইল বা পিলার ইতোমধ্যেই বসানো শেষ হয়েছে। পিলারের ওপর স্থাপন করা হয়েছে পিয়ার। আর এই পিয়ারের ওপর সুপার স্ট্রাকচার স্প্যান এবং সিøপারবিহীন রেলপথ স্থাপন করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি রেলসেতু।
যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের মেগা প্রকল্প দেশের বৃহত্তম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ের ৪ দশমিক ৮ কিমি সেতুর তিন দশমিক ৮ কিমি এখন দৃশ্যমান। কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ ভাগ । হিসাব অনুযায়ী পিয়ারের ওপর আর ১০টি স্প্যান স্থাপন শেষ হলেই সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ আগামী জুন মাসের মধ্যেই শেষ হবে এবং তা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে বলে প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন। সেতুর সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল প্রান্তের সংযোগ সড়কে রেলপথ স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলেছে।
রেল বিভাগের তথ্য মতে, ডুয়েল গেজ ডাবল-ট্র্যাকের এ সেতুটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু অর্থাৎ মেগা প্রকল্প। এটি রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ ও উন্নত হবে। এ ছাড়াও ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় কমাতেও এ সেতু সহায়তা করবে বলে রেল কর্তৃপক্ষ মনে করছেন।
বর্তমানে প্রতিদিন ৩৮টি ট্রেন চলাচর করছে এই পথে। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে পারাপার হওয়ায় সময় অপচয়ের পাশাপাশি সিডিউল বিপর্যয়ে বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। এ সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে ট্রেন চলবে ৮৮টি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ কাজের একযোগে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল প্রান্তে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে সেতুর পিলার নির্মাণের পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতুর তিনশ’ মিটার উজানে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করছে।
যমুনা নদীর ওপর তিনশ মিটার দূরত্বে পাশাপাশি দুইটি সেতু। একটি চলমান বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু, অপরটি নির্মাণাধীণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। বাংলাদেশ রেলওয়ের মেগা প্রকল্প দেশের বৃহত্তম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু ডুয়েল গেজ ডাবল ট্রাক সংবলিত রেলসেতু। এই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষে হলে সেতুর ওপর দিয়ে ২০২৪ সালে জুন মাস নাগাদ ব্রডগেজ ও মিটারগেজ দু’ধরনের ট্রেনই ঘণ্টায় ১২০ কিমি গতিতে পারাপার হতে পারবে।
জাপান ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে ১৬ হাজার ৭শ’ ৮১ কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প এখন বাস্তবায়নের পথে। দেশ বিদেশের সাত হাজারেরও বেশি শ্রমিক আর প্রকৌশলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ প্রান্তে দুটি প্যাকেজের আওতায় চলছে এই রেলসেতুর নির্মাণ কাজ।
সিরাজগঞ্জ প্রান্তে কাজ কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে টাঙ্গাইল অংশে। বর্ষায় উত্তাল যমুনায় কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ করতে চান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
রেলসেতু চালু হলে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনে আরও গতি আসবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে মধ্যেই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এই সেতু চালুর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ খাতে সড়ক পথের পাশাপাশি রেল যোগাযোগে আমূল পরিবর্তন হবে, খুলে যাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপার সম্ভাবনার দুয়ার।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবু ইউসুফ সূর্য বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে বর্তমান প্রতিদিন মাত্র ৩৮টি ট্রেন চলাচল করতে পারে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু চালু হওয়ার পর ৮৮টি ট্রেন চলাচল করতে পারবে। অপর প্রান্তের ট্রেনকে পারাপারের জন্য রেল থামিয়ে বসে থাকতে হবে না। কারণ এটি ডবল লাইনের হওয়ায় একই সঙ্গে একাধিক ট্রেন চলতে পারবে। এতে এ অঞ্চলে ব্যবসার প্রসার ঘটবে।
রেল সেতুটি নির্মাণ শেষ হলে আন্তঃদেশীয় যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি চলাচল করতে পারবে। এতে আমদানি-রপ্তানি খরচ কমে যাওয়াসহ বঙ্গবন্ধু সেতু ও মহাসড়কের ওপর চাপ কমবে। রেল সেতুটি নির্মিত হলে বঙ্গবন্ধু সেতুর ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ থেকে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হবে, কমবে পরিবহন খরচ, যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবন যাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
সিরাজগঞ্জ-২ (সদর-কামারখন্দ) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ড. জান্নাত আরা হেনরী বাংলাদেশরেলওয়ের এই মেগা পকল্প যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু প্রসঙ্গে বলেছেন, তার নাড়িপোঁতা সয়দাবাদ ইউনিয়নে রেল সেতুর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন- রেল সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুততম সময়ে শেষ হবে।
এটি হবে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিলাঞ্চলের মেলবন্ধন। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে সড়ক পথের পাশাপাশি রেলপথেও পণ্য পরিবহণ সহজতর হবে এবং খরচও সাশ্রয় হবে। উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আনবে।
প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘের সেতুটিতে ৫০টি পিয়ার এবং দু’টি পিয়ারের মাঝখানে একটি করে মোট ৪৯টি স্প্যান বসানো হবে।
প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য গড়ে ১শ’ মিটার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেছেন, ভৌত অবকাঠামোর কঠিনতম কাজ নদীর তলদেশে ৫০টি পাইল বা পিলার বসানোর কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে আনা বিশেষভাবে তৈরি মরিচারোধী বড় বড় স্টিলের কাঠামো দিয়ে তৈরি করা স্প্যান সেতুর ওপর বসানো হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে দেশে প্রথমবারের মতো ব্যবহার হচ্ছে জাপানী আধুনিক ডাইরেক্ট রেল ফ্যাসেনার প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে স্প্যানের ওপর সরাসরি বসানো হচ্ছে রেললাইন। এতে সেতুর ওপর রেল লাইনের স্থায়িত্ব বাড়ার পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম হবে। ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘের রেল সেতুর এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে তিন দশমিক আট কিমি। বিভিন্ন পর্যায়ে কাজের অগ্রগতি ৮২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ আগামী জুন নাগাদ শেষ হবে বলে জানান তিনি।
তিনটি প্যাকেজে আন্তর্জাতিক ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ডব্লিউডি-১ প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে জাপানের ওবাইসি-আইএইচআই ও এসএমসিসিনামে তিনটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। ডব্লিউডি-২ প্যাকেজের কাজ করছে জাপানের আইএইচআইও এসএমসিসি কোম্পানিএবং ডাব্লিউডি-৩ প্যাকেজের কাজও করছে জাপানের দু’টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন রেল সেতুতে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল প্রান্তে সহস্রাধিক দেশী-বিদেশী প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে প্রকল্পটির ৮২ শতাংশেরও বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ।