বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে ত্রিপুরা নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত

ফানাম নিউজ
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:১৪

বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আগরতলার নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উভয় দেশের মানুষের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। এই আত্মিক যোগাযোগ ধরে রাখতে উভয় দেশের মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে হবে। শিল্প, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে যোগাযোগ আরো বাড়াতে হবে। এজন্য ভিসার সহজীকরণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দুদেশের মানুষের আত্মিক সম্পর্ক বেঁধে রাখা যায় না।

সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের আমন্ত্রণে সফররত ত্রিপুরার আগরতলা প্রেস ক্লাবের একটি প্রতিনিধি দল এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।

মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, ত্রিপুরার রক্তের বন্ধন তৈরি হয়েছে। আগরতলার শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। আগরতলা থেকে সীমান্ত খুব কাছে ছিলো। তাই বিদেশী সাংবাদিকরা যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করার জন্য ত্রিপুরার আগরতলায় সবচেয়ে বেশি ভিড় করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আগরতলায় বসেই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছে। ত্রিপুরার সার্কিট হাউজে বসে যুদ্ধকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ত্রিপুরার গণমাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রতিদিন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের রক্তের বন্ধন তৈরি হয়েছে। ত্রিপুরার সার্কিট হাউজ, জিবি হাসপাতাল, পুরনো এমএলএ ভবন, পোষ্ট অফিস চৌমুহনী, কলেজটিলা ছাত্রাবাস, মেলারহাটের সুনন্দা ভট্টাচার্যের বাড়ি- ৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক একটি স্মরক হয়ে আছে। তখন ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিলো ১৪ লাখ। অথচ ১৫ লাখ বাংলাদেশের মানুষকে ত্রিপুরা আশ্রয় দিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় ঘাঁটি ছিলো আগরতলা।

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলে, মুক্তিযুদ্ধের আগরতলা নামটি আমরা কোনো ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আগরতলা একটি বড় স্থান জুড়ে আছে। ত্রিপুরার মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে প্রবলভাবে উদ্ভূদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার কারণে আগরতলা নিয়ে আরো কাজ করার আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগরতলা নিয়ে অনেক আগ্রহ আছে। স্মৃতি আমাদের শক্তি যোগায়। তাই স্মৃতি ধরে রাখতেই হবে।

শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক জায়গায় আগরতলার কথা বলেছেন। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ আরো বাড়ানো হলে আগরতলার ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। তবে ভিসা নীতি নিয়ে এখন তুঘলকি কাণ্ড চলছে। যতই সৌহাদ্যের কথা বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম হওয়ায় হোষ্টেজ রাষ্ট্র হিসাবে দেখা হচ্ছে। ভারতীয় ভিসার চেয়ে আমেরিকা ও কানাডার ভিসা পাওয়া অনেক বেশি সহজ। ভারতীয় ইমিগ্রেশনে জিজ্ঞাস করে, ‘বার বার আসেন কেন’। শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষার ক্ষেত্রে অবাধ আদান-প্রদান না হলে দুই দেশের মানুষের বন্ধুত্ব দৃঢ় হবে না।

প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী হাসেম খান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিদেশী বন্ধুদের সম্মানিত করেছেন। তারপরেও বলবো সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের এখনো সম্মানের সঙ্গে সামনে আনা হয়নি। এই সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা হলেন–ভারত ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের পূনাঙ্গ ইতিহাস সত্যিকারভাবে এখনো লেখা হয়নি। দুই দেশের মানুষের আত্মিক যোগাযোগ আরো বাড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার অবদান কখনোই ভোলা যাবে না। আমি অনেকবার ত্রিপুরায় গিয়ে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য স্মৃতি ত্রিপুরার মাটিতে আছে। বাংলাদেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধ ত্রিপুরার মাটিতে শুয়ে আছেন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, ভারত সরকার ও ত্রিপুরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আগরতলা নামটি জড়িয়ে আছে। উভয় দেশের মানুষের সম্পর্ক ধরে রাখে তা আরো উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে হবে। দুই দিকেই ভিসার জটিলতা আছে। ভিসা সহজীকরন এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুধু আত্মিক বললে হবে না, আরো অনেক বেশি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে ত্রিপুরার অবদান কখনো মুছে ফেলা বা ভুলে যাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে যে গণআন্দোলন শুরু হয় তা স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সব শ্রেণীর মানুষের সম্পৃক্ততা, ভালোবাসা ও আশ্রয় দিয়ে আত্মিক সম্পর্ক কোনো দিনই ভোলা যাবে না।

আগরতলা প্রেসক্লাবের সভাপতি জয়ন্ত ভট্রাচার্য বলেন, ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের ভিত তৈরী করেছে বঙ্গবন্ধু। তিনি এই সম্পর্কের সূচনা করেছেন। তিনি বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার মূল স্থপতি। তিনি অসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ভিত গড়েছেন। ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে দুই দেশের মানুষের সর্ম্পক আরো বাড়াতে হবে। আমরা সাংবাদিকরা দুই দেশের মানুষের দাবীগুলো তুলে ধরতে পারলে কিছুটা হলেও তা বাস্তবায়ন হবে। সংবাদকর্মীদের মধ্যেও সম্পর্ক আরো বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার প্রতিটি মানুষ বাংলাদেশের মানুষদের প্রচন্ডভাবে মানবিক সহযোগীতা করেছে।

ত্রিপুরার প্রথম মূখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ ওই সময় কেন্দ্র সরকারের অনুমতি ছাড়াই সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন। পুরো আগরতলা জুড়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিলো। ওই সময় আমি বয়সে ছোট হলেও অনেক ক্যাম্প ঘুরেছি। সব মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে ছিলো। একটি আলুসেদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে দেখেছি।

আগরতলা প্রেসক্লাবের সহসভাপতি সৈয়দ সাজ্জাত আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অনেক মানুষ আমাদের বাসাতেও এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে, এদেশের মানুষের সঙ্গে ত্রিপুরার মানুষের বন্ধন আরো দৃঢ় করতে চাই। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের আমলে আমরা বেশ নিরাপদ আছি। কিন্তু একসময় উত্তরপূর্ব ভারতের জঙ্গীগোষ্টীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ায় ত্রিপুরার নিরাপত্তা ভেঙ্গে পড়েছিলো এবং অনেক মানুষ মারা গেছে। কাঁটাতারের বেড়া আমাদের সম্পর্কের অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। আবার জঙ্গীদের উত্থান না হলে কাঁটাতারের বেড়াও হতো না। সবকিছুর পরও দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ আরো বাড়াতে হবে।