শিরোনাম
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয় গত বছরের ২৩ মার্চ থেকে। কিন্তু কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে সচিবালয়ে প্রবেশ করতেন আব্দুল কাদের মাঝি ওরফে আব্দুল কাদের চৌধুরী। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণি। তবে পরিচয় দিতেন অতিরিক্ত সচিব। এক কোটি ২০ লাখ টাকার প্রাডো গাড়িতে চলাচল করতেন। সেই গাড়িতে আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার ও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে ঢুকতেন সচিবালয়ে।
সচিবালয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বলছে, সচিবালয়ে প্রবেশের আগে প্রায় সব গাড়িই তল্লাশি করা হয়। তবে অফিস টাইমে একসঙ্গে অনেক গাড়ি প্রবেশের সময় কিছু শিথিলতা থাকে। কিন্তু নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই।
এদিকে, ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রবেশের ফলে প্রশ্ন উঠেছে সচিবালয়ের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়ে। কাদের সচিবালয়ের কোন কোন কর্মকর্তার কাছে যেতেন সে বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
অতিরিক্ত সচিব ছাড়াও কাদের নিজেকে সিআইপি বলেও পরিচয় দিতেন। এক কোটি ২০ লাখ টাকার দামি গাড়ি, বডিগার্ড, ওয়্যারলেস সেট ব্যবহার করতেন তিনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া কথিত ভুয়া কার্যাদেশ, মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে তার ছবি ও বিভিন্ন লেনদেনের ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করতেন। ৩৩ জন সচিবসহ বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে তার কনসোর্টিয়াম ও ব্যবসা রয়েছে বলেও প্রচার করতেন অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দেওয়া আব্দুল কাদের চৌধুরী।
দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে দেশের শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি ও খামার তৈরির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা এই প্রতারককে একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মিরপুর-৬ নম্বরের বাসা থেকে বাইরে যাওয়ার সময় নিজের প্রাডো গাড়িতে গ্রেফতার হন তিনি।
কাদেরের প্রতারণার নানা দিক তুলে ধরে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, কাদের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা করতেন। তার নিয়োগ করা মার্কেটিং অফিসাররা বিভিন্ন ঠিকাদার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রচারণা চালাতেন। ভুয়া অতিরিক্ত সচিব সেজে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা ফি নিতেন তিনি। ব্যাংক থেকে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ঋণ পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রসেসিং ফি বাবদ ডাউনপেমেন্ট হিসেবে নিতেন ৫ থেকে ১০ শতাংশ টাকা।
বিশ্বাস জন্মানোর জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত ও বিভিন্ন সরকারি প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছেন বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন। এসব ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডার দেখিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তা বিক্রি করা হতো। তাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা জামানত রেখে তিনি প্রতারণায় অংশ নিতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেন।
এছাড়াও সততা প্রপার্টিজের নামে নামমাত্র কিছু টাকা বায়নার মাধ্যমে জমি ও স্থাপনা কিনতে চুক্তি করেন কাদের, যেগুলো দিয়ে পরে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায় করেন। এই প্রতারণার কাজগুলো সম্পন্ন করতে স্বল্পশিক্ষিত কাদের নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপালন শেষে সবশেষ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পরিচয় দিতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের চাকরিচ্যুত এক ডিআইজির কথিত স্ত্রীর (যার অভিযোগে ওই ডিআইজি চাকরিচ্যুত হন) সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল কাদেরের। তিনি নিয়মিত কাদেরের পাঠানো গাড়িতে করে কারওয়ান বাজার অফিসে আসতেন। ওই নারী সেখানে কাদেরের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এছাড়াও এ চক্রটি অনেক সুন্দরী নারী ও ঢাকা-চট্টগ্রামের মডেলদের সাপ্লায়ারও ছিলেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সচিবালয়ে নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে সচিবালয় নিরাপত্তা উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মোর্শেদ আলম বলেন, স্টিকারযুক্ত সব গাড়ি চেক না করলেও কোন গাড়িতে কোন কর্মকর্তা যাচ্ছেন সেগুলো তদারকি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তার ডিউটি করতে করতে একটা অভিজ্ঞতা হয়। সচিবালয়ে প্রবেশের আগে প্রায় সব গাড়িই তল্লাশি করা হয়। তবে অফিস টাইমে একসঙ্গে অনেক গাড়ি প্রবেশের সময় কিছুটা শিথিলতা থাকে। কিন্তু নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। সচিবালয়ে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থেকে কাজ করে।
কে এই আব্দুল কাদের?
আব্দুল কাদেরের আদিবাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ভূমিহীন এক কৃষক পরিবারে। তার বাবা জীবিকার সন্ধানে সন্দ্বীপে পাড়ি জমান। মাছ ধরা ও মাঝির কাজ করে জীবিকা উপার্জন করতো তার পরিবার। এমন ভূমিহীন ভাসমান আব্দুল কাদেরের ঢাকা ও ঢাকার বাইরে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এর মধ্যে গুলশান-১ নম্বরের জব্বার টাওয়ারে প্রায় ছয় হাজার স্কয়ার ফিটের অফিস রয়েছে তার। কারওয়ান বাজারে রয়েছে আরও একটি অফিস। মিরপুর-৬ নম্বরে বসবাস করলেও একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে তার নামে। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আব্দুল কাদের হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, আব্দুল কাদের নয়তলা বাড়ি কিনেছেন গাজীপুরের বোর্ডবাজারে। গাজীপুরের পূবাইলে রয়েছে আট বিঘার বাগানবাড়ি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে তার একাধিক অ্যাকাউন্ট। যেখানে রয়েছে লাখ লাখ টাকা। অঢেল সম্পদের মালিক এই কাদেরের কোনো বৈধ উপার্জন নেই।
মুসা বিন শমসেরের আইন উপদেষ্টা এই আব্দুল কাদের
ডিবি জানিয়েছে, আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের নানা ব্যবসায়িক সম্পর্কের চুক্তিপত্রসহ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এমনকী মুসা বিন শমসেরের একটি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করতেন তিনি। কাদেরের প্রতিষ্ঠানে মুসা বিন শমসেরের একাধিক ছবি টাঙানো রয়েছে। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন শমসেরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাডভাইজার হিসেবে। প্রতারক আব্দুল কাদেরের কাছ থেকে মুসা বিন শমসের ও তার স্ত্রীর সঙ্গে করা কিছু চুক্তিপত্র উদ্ধার করেছে ডিবি।
মুসা বিন শমসের প্রতারণার স্বীকার, কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করবেন তিনি
মুসা বিন শমসের বলছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের একজন মিথ্যাবাদী। আমিও প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমি এই ভুয়া অতিরিক্ত সচিবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবো, তার বিরুদ্ধে মামলা করবো।
তিনি বলেন, ডিবি আমাকে আব্দুল কাদেরের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং আমি যা যা জানি সবকিছু স্পষ্ট বলেছি। আমার বক্তব্যে ডিবি পুলিশ সন্তুষ্ট।
আইন উপদেষ্টা পরিচয় দেওয়ার বিষয়ে মুসা বিন শমসের বলেন, আব্দুল কাদের মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি আমার আইন উপদেষ্টা ছিলেন না।
তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ছবি তোলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে অনেক লোক এসে ছবি তোলেন। কেউ ছবি তুলতে চাইলে আমি তাকে না করতে পারি না। আমার ছবি দেখিয়ে যদি কেউ প্রতারণা করে, সেটার দায়-দায়িত্ব আমি নিতে পারি না।
প্রতারক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে ২০ কোটি টাকার চেকের লেনদেনের তথ্য পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওটা আমি ফেরত দিয়ে দিয়েছি।
ডিবির যুগ্ম-কমিশনার হারুন-অর-রশীদ বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদেরের বিষয়ে মুসা বিন শমসেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মুসা বিন শমসের বলেছেন, তার সুইস ব্যাংকে ৮২ বিলিয়ন ডলার আটকে আছে। সেই টাকা পেলে তিনি পুলিশকে ৫শ কোটি টাকা দিতে চেয়েছেন। এছাড়াও তিনি দ্বিতীয় পদ্মা সেতু ও দুদকের ভবনও করে দিতে চেয়েছেন।
ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, মুসা বিন শমসেরকে আমার কাছে রহস্যময় মানুষ মনে হয়েছে। প্রতারক আব্দুল কাদের একজন নাইন পাস লোক, তাকে মুসা বিন শমসের উপদেষ্টা বানালেন কেন? ২০ কোটি টাকার চেক দিলেন কেন? উনি বলেছেন, লাভ দেবেন। কিন্তু উদ্দেশ্য আমরা জানি না। মুসা সাহেব দেখেছেন আব্দুল কাদের বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা বলেন। বাস্তবে আব্দুল কাদেরের সঙ্গে ওনার অনেক সম্পর্ক রয়েছে।
জানতে চাইলে গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, আব্দুল কাদের চৌধুরীর আসল নাম- আব্দুল কাদের মাঝি। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণি। কিন্তু তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে নিজেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পরিচয় দিতেন। নিজের এক কোটি ২০ লাখ টাকার প্রাডো গাড়িতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগিয়ে ঢুকতেন সচিবালয়ে।
তিনি বলেন, আব্দুল কাদের, তার স্ত্রী ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা, তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা রয়েছে। এর আগে তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণা, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে অর্ধ-ডজন মামলাও হয়েছে। তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আশা করছি, প্রতারণার সবকিছু তিনি খুলে বলবেন। এছাড়াও সচিবালয়ে প্রবেশ করে তিনি কোন কোন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতেন, আদৌ দেখা করতেন কি না সেসব বিষয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা। সূত্র: জাগো নিউজ