শিরোনাম
এইচএসসি পাশ সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুল (৩৮) মেহেরপুরের গাংনী থানাধীন কামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার হিসেবে কাজ করতো। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতো সে। অল্পসময়ে অধিক টাকার মালিক হওয়ার লোভে ধীরে ধীরে মানবপাচারকারী কোনও একটি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ও চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় প্রতারণামূলকভাবে ‘টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ’ নামে ৩টি এজেন্সি অফিস খুলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী-পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় টুটুল।
অবশেষে এই চক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন নারী ভিকটিমের অভিভাবক মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগ র্যাবে এ জানায়। এরপর র্যাব ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
বুধবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে ব্যাটালিয়ন-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ১৩ অক্টোবর রাতে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল বাড্ডার লিংক রোডস্থ টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালিয়ে ৪ জন ভিকটিম (২ জন পুরুষ ও ২ জন নারী), ১০টি পাসপোর্ট, ৭টি ফাইল, ৪টি সিল, ১৭টি মোবাইল, ৫টি রেজিস্টার, মোবাইল সিম ৩টি, ৪টি ব্যাংকের চেক বই, ২টি কম্পিউটার, ৩টি লিফলেট এবং নগদ ১০ হাজার ৭০ টাকাসহ মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা টুটুলসহ আট জনকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃত বাকিরা হলো— তৈয়ব আলী (৪৫), শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), মো. মারুফ হাসান (৩৭), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৩৮), মো. লালটু ইসলাম (২৮), মো. আলামিন হোসাইন (৩০) ও মো. আব্দল্লাহ আল মামুন (৫৪)।
টুটুলের এই প্রতারণার কাজে অন্যতম সহযোগী আবু তৈয়ব। সে কোনও পড়াশুনা জানে না। চায়ের দোকান ছিল তার। টুটুলের প্ররোচনায় মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ও বহু লোককে প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে পাঠানো এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা-পয়সা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। তৈয়ব নিজেকে দেশের একটি স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরি এবং দেশের নামী-দামী মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকজন ভিকটিমকে চাকরি প্রদানের ভুয়া নিয়োগপত্রও দিয়েছে।
এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত বাকিরা মাঠ পর্যায়ে টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিক্যাল সম্পূর্ণ করাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করতো। টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে এই চক্র মানুষকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করতো। তাদের কয়েকটি টিম দেশজুড়ে কাজ করে।
মাঠ পর্যায়ে টার্গেট সংগ্রহ: প্রথমত এই পাচারকারী চক্রের কিছু সদস্য দেশের বেকার ও অসচ্ছল যুবক-যুবতীদের সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নাম করে রাজি করিয়ে ঢাকায় টুটুল ও তৈয়বের কাছে নিয়ে আসে।
টাকা সংগ্রহ: এরপর টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে সংগ্রহীত ভিকটিমদের বিদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে ভুয়া মানিরিসিপ্ট প্রদান করে ভিকটিম প্রতি ২-৫ লাখ টাকা করে নিতো।
কথিত প্রশিক্ষণ: প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদেরকে উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ভিকটিমদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতো।
পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ: এই পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্টের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতো। এতে করে ভিকটিমদের মনে আর কোনও সন্দেহ থাকতো না। এই চক্রের কিছু সদস্য পাসপোর্ট অফিসের দালালদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি করে দিতো।
মেডিক্যাল করা: এই চক্রের মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে ভিকটিমদের বিদেশে যাওয়ার জন্য লোক দেখানো মেডিক্যাল সম্পন্ন করা হতো।
বিক্রির উদ্দেশে বিদেশে পাচার: সকল প্রক্রিয়া শেষ করে কয়েকজনকে বিদেশে পাঠিয়ে বাসাবাড়িতে কাজের কথা বলে বিশেষ করে নারী ভিকটিমদের বিক্রি এবং পুরুষ ভিকটিমদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্ডান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতো। উল্লেখ্য যে, বিদেশে পাচারকৃত ভিকটিমরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ করতে পারতো না। যাদেরকে বিদেশে পাঠাতে পারতো না তারা টাকা ফেরতের আশায় অফিসে যোগাযোগ করলে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা না দিয়ে আত্মসাৎ করে আসছিল।
অভিযোগকারী ব্যক্তির বক্তব্য:
র্যাব-৪ এর কাছে গাইবান্ধার মো. আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তার ভাতিজি আসমা বেগম তৈয়ব ও টুটুলের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়ে গত ৯ জুন জর্ডান যায়। তাকে বাসাবাড়িতে কাজের কথা বলে পাঠানো হলেও সে পাচার হয়েছে বলে তারা আশঙ্কা করেন। যাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ যোগাযোগ থাকলেও এখন আসমার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষকে প্রতারণামূলকভাবে সৌদি আরবে পাঠিয়ে বিক্রি করেছেন বলে র্যাব-৪ এর কাছে অভিযোগ করেন।
ভিকটিম মোরশেদা বেগম (৩৪), মোছা. হামিদা আক্তার (৩২), মোরশেদা বিবি (৩২) এবং মালেকা বেগম (৫১) একই উপায়ে তৈয়বের কাছে বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে মোরশেদা ও হামিদাকে অভিযানকালে টুটুলের অফিস থেকে উদ্ধার করা হয়। এরা প্রতারণার শিকার হয়ে দুই বছরের অধিক সময় তৈয়ব ও টুটুলের অফিসে ঘোরাফেরা করছেন। তারা র্যাব-৪ এ প্রতারণা ও পাচার সংক্রান্ত তথ্য দেন। এমন আরও ২০-২৫ জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম অবৈধ। এ ছাড়া টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ নামক প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোনও অফিশিয়াল সাইনবোর্ডও নেই। কোম্পানি থেকে সরকারি কোনও ভ্যাট/ট্যাক্স প্রদান করা হয় না। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, জাগো নিউজ