শিরোনাম
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো। প্রতি বছর কয়েক লাখ মুসল্লি একসঙ্গে এ ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করেন। ২০১৬ সালে ঈদুল ফিতরের জামাতের আগে ঘটে এক অপ্রীতিকর ঘটনা। প্রবেশপথের নিরাপত্তা চৌকিতে হয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। এতে দুজন পুলিশ কনস্টেবল, একজন গৃহবধূ ও এক জঙ্গি নিহত হন। আহত হন বেশ কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। বিষয়টি মাথায় রেখে এবারও নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ঈদ সামনে রেখে প্রায় পাঁচ মাস আগে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। ঈদুল ফিতরে তারা সেই সুযোগটি নিতে পারে বলে আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা।
তবে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট বলছে, দেশে জঙ্গিদের হামলার সক্ষমতা নেই। জঙ্গিদের সব ধরনের সক্ষমতা তলানিতে ঠেকেছে। তবু আসন্ন ঈদুল ফিতর কেন্দ্রে করে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
বুধবার (১৯ এপ্রিল) ঈদ উপলক্ষে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সারাদেশের ঈদগাহের জন্য ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ঈদের জামাত একদিন আগে হয়, সেখানেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঈদের জামাতে পুলিশের পোশাকে ও সাদা পোশাকে নিরাপত্তা থাকবে। এছাড়া র্যাব, ডিবি, এপিবিএন ও কমিউনিটি পুলিশিংসহ সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঈদুল ফিতরের ১৯৬তম জামাতের জন্য প্রস্তুত কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। ২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার কলঙ্কজনক অধ্যায় সামনে রেখে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শহরের উপকণ্ঠে নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো এ ঐতিহাসিক ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতরের জামাতে দেশ-বিদেশের তিন লাখেরও বেশি ধর্মপ্রাণ মুসল্লি নামাজ আদায় করেন।
ঈদুল ফিতরের জামাতের প্রস্তুতি নিয়ে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তা সম্পর্কে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তা নিয়ে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় রয়েছে। স্থানীয় হোটেল-মোটেলে অপরিচিত কেউ এসে থাকলে জেলা পুলিশকে জানাতে বলা হয়েছে। মুসল্লিরা যখন ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহে আসবেন তখন প্রত্যেকের চেকপোস্টের মাধ্যমে মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যে সার্চ করে ভেতরে ঢোকানো হবে। এছাড়া যখন মুসল্লিরা মাঠে প্রবেশ করবেন তখন আর্চওয়ে গেটের মাধ্যমে প্রবেশ করবেন।
তিনি বলেন, মাঠজুড়ে ড্রোন ক্যামেরা, ওয়াচ-টাওয়ারসহ সিসি ক্যামেরা নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত হবে। গত বছর যে সংখ্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ছিল তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি ফোর্স মোতায়েন থাকবে এবার। জেলা পুলিশের সদস্যরা ইউনিফর্ম ও সিভিলে মোতায়েন থাকবেন। এছাড়া জেলা গোয়েন্দা, পুলিশের বিশেষ শাখা, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশনায় পুলিশের জঙ্গি প্রতিরোধ ইউনিট অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পাঁচ প্লাটুন বিজিবি শোলাকিয়ায় মোতায়েন থাকবে। পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জের এসপি মোহাম্মদ রাসেল শেখ আরও বলেন, ঈদের নামাজ পড়তে জায়নামাজ ছাড়া অন্য কিছু আনা যাবে না। যে কোনো দাহ্য পদার্থ না আনার জন্য অনুরোধ রইলো। মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে আসার বিষয়ে নিষিদ্ধ করছি না, তবে না আনার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতরের প্রধান ঈদ জামাতে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও কূটনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। পাশাপাশি নারীদের জন্যও আলাদা নামাজের ব্যবস্থা থাকে। এছাড়াও ঢাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদের প্রধান জামাতে অংশ নেন। তাই এ ঈদগাহটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিবেচনায় নিরাপত্তা বাহিনী ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা কড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলবে।
সরেজমিনে জাতীয় ঈদগাহ ময়দান ঘুরে দেখা যায়, বিশাল এলাকাজুড়ে প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে পুরো মাঠ। পানিরোধক শামিয়ানা দিয়ে ছাউনি প্রস্তুত। এখন ভেতরে নামাজের জায়গা, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি এবং সাদা কাপড় দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে মাঠের ভেতরের অংশ। স্থাপন করা হচ্ছে সাউন্ড সিস্টেম। মুসল্লিদের নিরাপত্তার জন্য ঈদগাহ ময়দানের ভেতরসহ ঈদগাহজুড়ে নিরাপত্তার জন্য স্থাপন করা হচ্ছে সিসি ক্যামেরা।
সিটিটিসি বলছে, আদালত চত্বর থেকে পুলিশকে আক্রমণ করে ছিনতাই হওয়া আনসার-আল-ইসলামের দুই জঙ্গি দেশেই আছে। সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে তারা দুজন আলাদা স্থানে অবস্থান করছে। আদালত থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ছয় মাস আগে থেকে কারাগারে গিয়ে গ্রেফতার শিখা সোহেলের সঙ্গে পালানোর যাবতীয় কৌশল রপ্ত করেন। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন শিখা। জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার দিনেও শিখা স্পটে ছিলেন এবং দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর একটি আনসার ক্যাম্পে নিয়ে যান।
সোহেল আনসার আল ইসলামের সামরিক (আসকারি) শাখার সদস্য ছিলেন। সোহেলের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে শিখা আরও গভীরভাবে সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সব ধরনের ঝুঁকি পর্যালোচনা করে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে র্যাবের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সারা দেশে র্যাবের কন্ট্রোলরুম, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ, চেকপোস্ট ও সিসিটিভি মনিটরিংসহ যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ডগ স্কোয়াড ও হেলিকপ্টারগুলো সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় ঈদগাহসহ গুরুত্বপূর্ণ ঈদগাহগুলোতে ডগ স্কোয়াড ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সঙ্গে থাকবে পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরার কাভারেজ। যে কোনো নাশকতা-হামলা মোকাবিলায় পর্যাপ্তসংখ্যক টহল মোতায়েন ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর মাধ্যমে নাশকতাসহ যে কোনো ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। এছাড়াও র্যাব স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিমকে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ঈদে জঙ্গি হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ঈদে কোনো হামলার আশংকা নেই। সিটিটিসি জঙ্গিদের সব ধরনের হামলার সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম। তবে ঈদ উপলক্ষে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। জাতীয় ঈদগাহসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থাপনাকেন্দ্রিক নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
দুই জঙ্গি গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই জঙ্গি দেশেই পালিয়ে রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।