শিরোনাম
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির বিরুদ্ধে ৪৭২ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ওই মামলার তদন্ত আগামী ৩ মাসের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন।
আদালতে আজ শুনানি করেন দুদকের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
এর আগে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান হাইকোর্টে এক প্রতিবেদন দাখিল করে জানান, এসএওসির ৫ পরিচালকের একজন এবং এর ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি মঈনুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত চলছে। তখন আদালতে জানানো হয়, মঈনুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে অনিয়মে জড়িতের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুদক। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে।
গত বছরের ৬ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট একই বেঞ্চ বিপিসি ও অডিটর জেনারেলকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হলে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন।
একই সঙ্গে ৪৭২ কোটি টাকার অনিয়মের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এবং মহা হিসাব নিরীক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ নির্দেশ দেন আদালত।
পাশাপাশি অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশন, অডিটর জেনারেল ও বিপিসির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা ও প্রতিবেদনও দাখিল করতে বলেন হাইকোর্ট। তারই ধারাবাহিকতায় আজ সেটি শুনানি করেন আদালত।
গত ৪ নভেম্বর গণমাধ্যমে বিপিসির ৪৭২ কোটি টাকার অনিয়মের খবর প্রকাশিত হয়। তা হাইকোর্টের নজরে আনেন দুদকের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির (এসএওসিএল) ২১ অনিয়মের কারণে সরকার ৪৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এসএওসিএলের নথি পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানতে পেরেছে।
বিপিসি ও এশিয়াটিক ইন্ডাস্ট্রিজের মধ্যে ৫০-৫০ যৌথ উদ্যোগ এসএওসিএল। প্রতিষ্ঠানটি ইঞ্জিন তেল, যানবাহনের তেল, ডিজেল, বিটুমিন, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস ও ফার্নেস তেল বিপণন ও বিতরণ এবং কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানে জেট ফুয়েল সরবরাহ করে।
এসএওসিএলের নথি পর্যালোচনায় যেসব অসঙ্গতি দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে শীর্ষ কর্মকর্তাদের দ্বারা অর্থ আত্মসাৎ, উচ্চ হার, ওভারটাইম, অনুপস্থিত তহবিল, মামলা-মোকদ্দমা ফি প্রদানে অনিয়ম ও আয়কর অধ্যাদেশ এবং ভ্যাট বিধি লঙ্ঘন।
প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ পরিচালকের একজন ও এর ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি মঈনুদ্দিন আহমেদ এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ২০১১-১২ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত মঈনুদ্দিন আহমেদের মালিকানাধীন এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির কাছে এসএওসিএলের বিক্রি করা লুব্রিকেটিং তেলের বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে সংস্থাটির ১৯৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এসএসিওএলের নথিগুলোতে দেখা গেছে, এওসিএল চালানের বিপরীতে চেক সরবরাহ করেছিল। তবে চেকে উল্লেখ করা অর্থ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়নি। এছাড়া কোম্পানি আইন অনুযায়ী, অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ ধরনের লেনদেন নিষিদ্ধ। বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে এওসিএলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিএজি বলছে, ‘এটি গুরুতর অনিয়ম’।
২০১১-১২ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত কোম্পানির জন্য এসএওসিএলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অগ্রিমের জন্য কোনো ভাউচার বা চালান সরবরাহ না করেই ৮৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন মঈনুদ্দিন আহমেদ। তিনি ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত ২৩ কোটি ১১ লাখ টাকা অগ্রিম হিসেবে তুলে নিয়েছেন। কারণ টাকা তোলার কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। তিনি কখনো এ টাকা ফেরতও দেননি।
সিএজি যখন কোম্পানির কাছ থেকে এ অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়েছিল, তখন তারা বলেছিল যে এটি ছিল লুব-ভিত্তিক তেল, অ্যাডিটিভস ও অন্যান্য কাঁচামাল আমদানির জন্য স্থানীয় ব্যয় ছিল। উত্তরটি সন্তোষজনক না হওয়ায় সিএজি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
অর্থ তছরুপের দুটি ঘটনায় মঈনুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং তার ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, এসএওসিএলের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়ে মঈনুদ্দিন আহমেদ গুলশানে ১২ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় তার স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট এবং ১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা দিয়ে রাজধানীর লালমাটিয়া, উত্তর কমলাপুর, বারিধারা, বসুন্ধরা ও চট্টগ্রামের হালিশহরে ৬টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এসএওসিএলের চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ৩৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা তুলে সেই অর্থ নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেন মঈনুদ্দিন আহমেদ।
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে আমদানি করা এক লাখ ৩৪ হাজার ৩২৫ ড্রাম বিটুমিন হারিয়ে যাওয়ার কারণে এসএওসিএলের বইয়ে ৬৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঘাটতি রয়েছে। বিটুমিন ড্রামগুলো চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনির গুদামে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সেখানকার প্রহরী জানান, এসএওসিএলের চাহিদাপত্র দেখেই তিনি সেই পণ্য নিয়ে যেতে দিয়েছেন। তবে গুদামের মালিক এ ধরনের কোনো চাহিদাপত্রের কথা অস্বীকার করেন।
প্রতিষ্ঠানটির কাছে কোনো স্টক রিপোর্ট ছিল না। নিরীক্ষকরা এ ধরনের ঢিলেঢালা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিপিসিকে দায়ী করেন। পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য এ বিষয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত লুব-ভিত্তিক তেল ও বিটুমিন আমদানির খাতে এসএওসিএলের অ্যাকাউন্টে আরও ৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার ঘাটতি রয়েছে।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ গালফ পেট্রোলিয়াম পিটিই, গালফ পেট্রোলিয়াম পিএলসি, ইউনাইটেড অয়েল কোম্পানি ও ইউনাইটেড পেট্রোকেমিক্যালের নামে নন-অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক ইস্যু করেছিল। চেকগুলোর অর্থ উত্তোলন করা হয়েছিল।
তবে এর বিপরীতে কোনো ভাউচার বা চালান পাওয়া যায়নি। কিছু চেকের পেছনে করা সইয়ে দেখা গেছে, এসএওসিএল কর্মকর্তারা চেকগুলো থেকে অর্থ উত্তোলন করেছিলেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এ অনিয়মের পেছনে দায়ী মঈনুদ্দিন আহমেদ ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ। তারা দুজন সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা দিয়ে জীবন বীমার প্রিমিয়ামও কিনেছিলেন। এসএওসিএলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেই সেই টাকা পরিশোধ করা হয়।