এক যুগেও রাসায়নিক গুদামমুক্ত হলো না পুরান ঢাকা

ফানাম নিউজ
  ১১ অক্টোবর ২০২১, ১০:৫৪

২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলী ও ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়েছেন ১৯৫ জন। পুড়ে অঙ্গার হওয়া মানুষের হৃদয়বিদারক ছবি তখন পুরো দেশকেই কাঁদিয়েছিল। এতে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম নিয়ে। প্রথম ঘটনার পরই সরকার দ্রুত এসব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলার ঘোষণা দেয়। দ্বিতীয় ঘটনার পর সরানোর কাজে তাগাদা দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু প্রথম দফায় ঘোষণার প্রায় এক যুগ হতে চললেও তা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

সরেজমিনে পুরান ঢাকায় গিয়ে দেখা যায়, বহাল তবিয়তে রয়েছে ছোট-বড় এসব রাসায়নিক গুদাম। নামে-বেনামে বা সাইনবোর্ড সরিয়ে রেখে আগের মতোই চলছে রাসায়নিকের ব্যবসা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানকার কারখানা সরিয়ে নিতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক শিল্পপার্ক স্থাপনের কাজ চলছে, যা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ সম্পন্ন হতে পারে। শিল্পপার্কটি হলে গুদামগুলো স্থায়ীভাবে পুরান ঢাকা থেকে সরানো যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলী দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই রাসায়নিক গুদাম-কারখানা স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন এবং নতুন লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেয়। গুদামগুলোর পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। এতে বন্ধ ছিল গুদামগুলোর কাজ। কিন্তু কিছুদিন পরই আগের অবস্থায় ফিরে যায় এসব রাসায়নিক গুদাম।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত বছর পুরান ঢাকায় কতটি রাসায়নিক গুদাম, কারখানা বা দোকান রয়েছে তা খুঁজে বের করতে দায়িত্ব দেয় ডিএসসিসিকে। তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রায় দুই হাজার গুদামের তালিকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে জমা দেয়।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, চকবাজারসহ বেশকিছু এলাকায় গিয়ে গত কয়েক দিনে দেখা যায়, রাসায়নিকের গুদাম এখনও রয়েছে। আগের মতোই কর্মব্যস্ততা দেখা যায় সেখানকার ব্যবসায়ী, কর্মচারী, শ্রমিকদের মাঝে। তবে নজর এড়াতে প্রতিষ্ঠানের নাম মুছে দিয়ে বা গুদাম ও কারখানায় সাইনবোর্ড ছাড়াই ব্যবসা করছেন অনেকে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে ঠিকানা বদল করে।

চলতি বছরের ২২ এপ্রিল মধ্যরাতে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশন নামে একটি ছয়তলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর খবর জানা যায়।

সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আরমানিটোলা মাঠ সংলগ্ন আরমানিটোলা রোডের সরু গলির ভেতরেই পাঁচতলা একটি বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিকের গুদাম। দুজন কর্মচারী সকালে কাজ করে শাটার খুলেই রাসায়নিক গুদামের প্রবেশপথে ঘুমিয়েছেন। ভেতরে সারি সারি পাউডারজাতীয় রাসায়নিকের বস্তা। বাড়িটির দ্বিতীয় তলা থেকে পঞ্চম তলার পুরোটাই আবাসিক ফ্ল্যাট। শুধু তাই নয়, এর সামনে-পেছনে, আশপাশের সবগুলোই আবাসিক ভবন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার স্থানীয় এক ফার্মেসি দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুদামটিতে পাউডারজাতীয় রাসায়নিক আছে। বস্তায় করে রাখা আছে এসব রাসায়নিক পদার্থ। যখন মালামাল আনা-নেওয়া করা হয় তখন ঝড় হলে যেমন ধুলা হয়, তেমন অবস্থা দেখা যায় পুরো গলিতে।

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন আতঙ্কে থাকি কখন অ্যাকসিডেন্ট হয়। যখন ধুলার মতো ওড়ে তখন মনে হয়, হালকা আগুনের স্পর্শ পেলেই দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।’

ওই এলাকার অধিকাংশ দোকানেই দেখা যায়, শত শত রাসায়নিকের বস্তা ও ড্রাম সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা রাসায়নিকের ড্রাম তুলছেন। কেউ গুদাম থেকে পাউডারজাতীয় রাসায়নিকের বস্তা মাথায় নিয়ে ট্রাক, পিকআপ বা ঠেলাগাড়িতে রাখছেন।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন নামে একটি ভবনে। এতে
সেদিনই ৬৭ জনের মৃত্যু হয়। পরে আরও চারজন প্রাণ হারান। সবমিলিয়ে সেই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১-এ।

সেই চুড়িহাট্টা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে ঠিক কয়েকটি ভবন এগিয়েই আজগর লেনের ১১ নম্বর ভবন। বাসার সিঁড়ির পাশের বড় একটি গেট তালাবদ্ধ করে রাখা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী আছে।

সেখানকার এক বাসিন্দা জানান, বাসাটির নিচতলায় পাউডারজাতীয় রাসায়নিকের গুদাম। সাধারণত গেটটি খোলা হয় না। মাঝে মাঝেই দেখা যায় ছোট ছোট পিকআপ ভ্যান আসে। গুদাম থেকে বস্তাগুলো পিকআপে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে থাকা এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নিচে পুরাডাই কেমিক্যালের গুদাম, দোকান আছে পাশের মার্কেটে।’

একই কথা জানান ফজলু মিয়া নামে আরেকজন। তিনি বলেন, ‘কেমিক্যালের দোকান আছে। দোকানের ভেতরে গুদামও আছে।’

আরমানিটোলায় এক রাসায়নিকের গুদামে কাজ করেন রুবেল। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকায় আগুন লাগার ঘটনার পর বড় গুদাম এখন কম। তবে ব্যবসার সুবিধার্থে কেউ অফিস বা দোকানের সঙ্গে, কেউ আশপাশে অন্য জায়গায় ছোট গুদাম এখনও রেখেছেন। এমন হাজারখানেক গুদাম পাওয়া যাবে শুধু আরমানিটোলায়ই।

আরমানিটোলা থেকে মিটফোর্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নানান রকম তরলজাতীয় রাসায়নিক পড়ে আছে রাস্তায়। এতে রাসায়নিকের মিশ্র এক গন্ধ ভাসে বাতাসে।

মিটফোর্ড এলাকায় ৮-৯ বছর ধরে ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা করেন মো. জয়নাল আবেদিন। কেমিক্যালের গন্ধে কীভাবে থাকেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব গন্ধ মানিয়ে নিয়েছি।’

অসুস্থ হন কি না জানতে চাইলে জয়নাল বলেন, ‘সর্দি লাগে, মাঝে মাঝে জ্বর আসে।’

সরকারের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণার পরও আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক গুদাম থাকার বিষয়ে কথা বলতে মিটফোর্ড গির্জা মার্কেটে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে গেলেও সংগঠনটির সভাপতি মোস্তফা রহমান খোকা ও সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেনকে পাওয়া যায়নি।

পরে আরিফ হোসেনের দোকানে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি প্রথমে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে বলেন, ‘বিষয়টি সরকারের। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে আমাদের নিষেধ আছে।’

এ নিয়ে ওই এলাকার ক্ষুদ্র কেমিক্যাল ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, ‘অনেক গোডাউন এখন পড়ে আছে। কোনোটা বন্ধ, কোনোটা চলছে। সরকার যেখানে জায়গা দিয়েছে সেখানে গিয়ে অনেকে ব্যবসা করতে পারবে না। শুনছি দোকান সব নাকি উঠিয়ে দেবে, এখানে কেমিক্যালের ব্যবসা থাকবে না!’

চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর সমালোচনার মুখে সাময়িকভাবে গুদাম সরাতে কেরানীগঞ্জ ও টঙ্গিতে দুটি প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। দুটি প্রকল্পই এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও আড়াই বছরেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি।

অন্যদিকে গোডাউনগুলো স্থায়ীভাবে সরিয়ে নিতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জমিতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কেমিক্যাল শিল্পপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। একনেকে ২০১৯ সালের ১০ জুন কেমিক্যাল শিল্পপার্ক স্থাপনের প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। তখন মাটি ভরাটসহ প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও এরপর করোনা মহামারি ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় কাজে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দেয়। তবে এখন সেই কাজ দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব মো. মোশতাক হাসান বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা থাকায় প্রকল্পের ৪০ ভাগ কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে। আগামী নভেম্বরের মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হবে।’

পুরো প্রকল্পের কাজ কবে নাগাদ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে বিসিক চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন দ্রুত কাজ চলছে। পুরো প্রকল্পের কাজ আগামী বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করে পার্ক চালু করতে পারবো বলে আশা করছি।’ সূত্র: জাগো নিউজ