শিরোনাম
একটি পদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নির্ধারণে ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে এ জালিয়াতি ঘটেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নতুন সৃষ্ট ‘ডিজাইন ও মনিটরিং’ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নির্ধারণে এমনটি হয়েছে। সূত্র: যুগান্তর
জালিয়াতির মূল ঘটনা ঘটেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অনুবিভাগে। অপরদিকে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের টিএ শাখায় এ সংক্রান্ত ফাইল থেকে মূল নথি গায়েব করা হয়। সেখানে স্বাক্ষর জালিয়াতির তিনটি পৃষ্ঠা সংযুক্ত করা হয়েছে।
টানা নয় মাস তদন্তে এসব ঘটনা বেরিয়ে এসেছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। তবে ওই প্রতিবেদনে কারা সরাসরি জড়িত তাদের নাম চিহ্নিত করতে পারেননি কমিটির সদস্যরা। বের হয়নি নেপথ্যে থাকা কর্মকর্তাদের নামও। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, এমন জালিয়াতির ঘটনায় মাশুল দিতে হচ্ছে সরকারকে। ওই ঘটনায় মাঝপথে আটকে আছে বিআইডব্লিউটিএর ১৫০টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানের ৬৭৭টি পদ সৃষ্টির কার্যক্রম।
লোকবল সংকট থাকায় দুই হাজার ৭৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্পের আওতায় কেনা ১৫০টি জলযান সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে না সংস্থাটি। একটি বড় ড্রেজার পরিচালনায় ২০ জন জনবল অনুমোদন পেলেও বেশ কয়েকটি একজন, দুজন করে পাহারাদার হিসেবে রাখা হয়েছে।
অনেক নৌযান ঠিকাদারদের ডকইয়ার্ডে বছরের পর বছর পড়ে আছে। আবার পুরোনো ড্রেজার ও নৌযান থেকে লোকবল সরিয়ে নতুন জলযানে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে এসব নৌযান নির্মাণে সরকারের ব্যয় করা টাকার সুফল মিলছে না।
নৌপরিবহণ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেয়েছি। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জনবল নিয়োগের সঠিক প্রস্তাবটি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়েছে।
অর্থ বিভাগের কোনো এক পর্যায় থেকে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি পরিবর্তন করা হয়েছে। কোথায় বা কারা এ পরিবর্তন করেছে তা নির্ণয় করা যায়নি। জনবল অনুমোদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে জনবল অনুমোদনের বিষয়টি জড়িত। জনবল অনুমোদনের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে জনবল সংকট থাকায় অনেক ড্রেজার, টাগবোটসহ অন্যান্য জলযান বসে আছে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় বেশকিছু ড্রেজার ও সহায়ক জলযান বসে আছে। অথচ বিভিন্ন স্থানে নাব্য সংকট দূর করতে এসব ড্রেজারের চাহিদা রয়েছে।
এতে সংস্থার কাজের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, যেসব ড্রেজার বা জলযান চলছে, সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় কমসংখ্যক জনবল রয়েছে। এতে ওই জলযানের লোকজনকে অতিরিক্ত খাটতে হচ্ছে।
এতে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারা জলযান থেকে অন্যত্র বদলি হতে তদবির করছেন। সংস্থাটির চেয়ারম্যান জানান, লোকবল সংকটের কারণে ড্রেজারসহ জলযানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এতে আয়ুষ্কালও কমে যাচ্ছে।
দুটি শিপইয়ার্ডের মালিকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাদের ডকইয়ার্ডে নির্মাণ করা বিআইডব্লিউটিএর জাহাজ অলস বসে আছে। জাহাজের ইঞ্জিন সচল রাখতে নিয়মিত চালু করার কথা থাকলেও তা নিয়মিত করা হয় না। ডকইয়ার্ডের লোকজন দিয়ে এসব নৌযান পাহারা দেওয়া হয়।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে : ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘১০টি ড্রেজারসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি/যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৭৬টি জলযান কেনা হয়। দুই হাজার ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘২০টি ড্রেজারসহ সহায়ক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় ১১২টি জলযান কেনা হয়।
দুই প্রকল্পের আওতায় কেনা ১৮৮টি জলযানের বিপরীতে ১০ ড্রেজার প্রকল্পের ৩৮টি জলযানের ৩১২ জন জনবল অনুমোদন পেয়েছে সংস্থাটি। বাকি ১৫০টি জলযান ও ৯টি ড্রেজার বেইজের জন্য ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল এক হাজার ৬০১টি পদ সৃষ্টির সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ওই প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে পদ সংখ্যা কমিয়ে ৬৭৭টি পদ সৃষ্টির সম্মতি দেয় অর্থ বিভাগের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান-১ শাখা। পরে তা বেতন গ্রেড নির্ধারণ করে বাস্তবায়ন অনুবিভাগ।
এর পরই দেখা যায়, প্রধান প্রকৌশলী (ডিজাইন ও মনিটরিং) পদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার শর্তে পরিবর্তন এসেছে। এতে নৌ-প্রকৌশলী/উপব্যবস্থাপক এর সঙ্গে উপপ্রধান প্রকৌশলী শব্দ যুক্ত করা হয়।
এ পরিবর্তনের কারণে প্রধান প্রকৌশলী পদে যান্ত্রিক ও নৌ-প্রকৌশল পুলের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পুরকৌশল পুলের কর্মকর্তাদের এ পদে পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
এরপরই ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মেরিন) মো. আতাহার আলী সরদার, পরে সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মাহাবুবুল ইসলাম পাটোয়ারীসহ কয়েকজন প্রতিকার চেয়ে নৌ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন।
পরে কয়েকজন তাদের আবেদন প্রত্যাহার করেন। মাহাবুবুল ইসলাম পাটোয়ারীর আবেদন আমলে নিয়ে একই বছরের ২৬ নভেম্বর নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. আ.ন.ম. বজলুর রশীদকে আহ্বায়ক ও উপসচিব মো. মনিরুজ্জামান মিঞাকে সদস্য করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কমিটি নয় মাস পর গত আগস্ট মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়।
যা আছে তদন্ত প্রতিবেদনে : পাঁচ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাস্তবায়ন অনুবিভাগে বেতন গ্রেড নির্ধারণে পদোন্নতির যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা পরিবর্তন করা হয়েছে।
কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবিত নিয়োগ যোগ্যতার সঙ্গে অর্থ বিভাগের নির্ধারিত নিয়োগ যোগ্যতার গরমিল পাওয়া গেছে। তবে অর্থ বিভাগ থেকে চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নথি না পাওয়ায় কারা জড়িত তা খুঁজে পায়নি কমিটি।
জালিয়াতির এ তথ্য উল্লেখ করে গত সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে একটি চিঠি দিয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে এ ঘটনায় তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়েও জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, জনবল সৃষ্টি করতে বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাবটি স্পাইরাল আকারে ছিল।
ওই স্পাইরাল বাইন্ডিংয়ের তিনটি পাতায় সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও দুজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্পাইরাল বাইন্ডিংয়ে ওই তিনটি পৃষ্ঠা আলাদা করে পিন দিয়ে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এমনকি এ মন্ত্রণালয়ের টিএ শাখার তৎকালীন উপসচিব মো. আনোয়ারুল ইসলামের সত্যায়ন করার বিষয়টিও জালিয়াতি করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান-১ শাখায় যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সেই অফিস কপি টিএ শাখার ফাইলে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় জড়িত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম উল্লেখ করা হয়নি প্রতিবেদনে। তবে জালিয়াতির জন্য টিএ শাখার তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার ওপর দায় চাপিয়ে ব্যবস্থা নিতে নৌ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধিশাখায় অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এক জালিয়াতিতে আটকে আছে ১৫০ জলযানের জনবল : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নয় মাস ধরে তদন্ত চলতে থাকায় অর্থ মন্ত্রণালয় যে ৬৭৭টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব অনুমোদন করে তা সচিব কমিটিতে পাঠানো হয়নি।
এ কারণে এসব জনবল নিয়োগ আটকে আছে। জোড়াতালি দিয়ে ড্রেজারসহ সহায়ক জলযান পরিচালনা করছে বিআইডব্লিউটিএ। বংশী নামের ড্রেজারে ২০ জন জনবলের প্রয়োজন থাকলে তা পাহারা দেওয়ার জন্য একজনকে দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে বলেশ্বর ও বাঙ্গালী ড্রেজারে দুইজন করে, বিশখালী ও বরাক ড্রেজারে তিনজন করে জনবল রয়েছে। এ কমসংখ্যক জনবল দিয়ে ড্রেজার পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা।