আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমলেও সুখবর নেই দেশের আটা-ময়দার দামে

ফানাম নিউজ
  ০৫ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪৬

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম নিয়ে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও তৈরি হয় অস্থিরতা। ভারতও বন্ধ করে দেয় রপ্তানি। গত কয়েক মাসের অস্থিরতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা কমেছে গমের দাম। ইউক্রেনও শুরু করেছে শস্য রপ্তানি। তবে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় দেশের বাজারে গমের দাম কমছে না বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাই সহসাই কোনো সুখবর মিলছে না আটা-ময়দার দামেও।

খাদ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৬০ টন গম মজুত রয়েছে দেশের সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে। তবে গত বছরের একই সময়ে গমের মজুত ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার ৪১০ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরের ৩ আগস্ট পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো গম আমদানি না হলেও বেসরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ৪২ হাজার ৯৯০ টন গম। তবে গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারিভাবে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ১২০ টন গম আমদানি হয়। একই সময়ে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়েছে ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯০ টন গম।

এদিকে চলতি বছরে ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১ লাখ ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহের কথা বলা হলেও মাত্র ২০ টন গম সংগ্রহ করতে পেরেছে খাদ্য অধিদপ্তর। কিন্তু গত বছর একই সময়ে ১ লাখ ৩ হাজার ২১২ টন গম সংগ্রহ করেছিল খাদ্য বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ৬৩ হাজার ৪০০ টন গম আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়।

খাদ্য বিভাগ বলছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী জাহাজীকরণের আগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম টনপ্রতি ৩৬২ দশমিক ৫০ ডলার, আমেরিকান গম ৩৪১ ডলার। যাবতীয় আমদানি খরচ মিলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিকেজি রাশিয়ান গম ৪০ টাকা ৭৩ পয়সা, ইউক্রেনের গম ৪০ টাকা ৫৪ পয়সা এবং আমেরিকান গম ৪০ টাকা ৪০ পয়সা দাঁড়ায়।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ৩ আগস্ট বাজারে খোলা আটা প্রতিকেজি ৪০-৪২ টাকা এবং প্যাকেটজাত আটা ৪৮-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে খোলা ময়দা প্রতিকেজি ৫৫-৫৮ টাকা এবং প্যাকেটজাত আটা ৬২-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরেজমিনে চট্টগ্রামের খুচরা মুদি দোকানগুলোতে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মুদির দোকানে  পুরোনো দামে বিক্রি হচ্ছে আটা ও ময়দা।

কাজির দেউড়ি এলাকার খুচরা মুদি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখনো পুরোনো দরে আটা বিক্রি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো নতুন দরের আটা সরবরাহ করেননি। পুষ্টি ব্র্যান্ডের প্রতিকেজি প্যাকেটজাত আটা ৫৫ টাকায় বিক্রি করছি। তবে একই কোম্পানির নতুন ময়দা বাজারে এসেছে। এসব ময়দা ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।’

আরেক মুদি দোকানি মিজানুর রহমান জানান, পুষ্টি এবং তীর ব্র্যান্ডের আটা-ময়দা রয়েছে তাদের দোকানে। আটা প্যাকেটের গায়ে ৫৫ টাকা লেখা থাকলেও তারা ৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। একইভাবে ময়দা বিক্রি করছেন ৬৮-৭০ টাকায়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত এপ্রিল থেকে বিশ্বে গমের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। বাংলাদেশে হু হু করে দাম বাড়তে থাকে গমের। ফলে আটা-ময়দা থেকে শুরু করে গমজাত খাদ্যপণ্যের দামও বাড়তে থাকে। কানাডা বাদে বাংলাদেশের গমের অন্যতম উৎস রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত। যুদ্ধের কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন ও সবশেষ ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা বেশি থাকলেও ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪০ লাখ ১২ হাজার টন গম আমদানি করতে পেরেছে। তবে সুখবর হচ্ছে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন ঐকমত্যে পৌঁছেছে। দুই দেশ এরই মধ্যে চুক্তিও করেছে। চুক্তির পর গম রপ্তানি শুরু করেছে ইউক্রেন। তবে ইউক্রেন থেকে এখনো বাংলাদেশে কোনো গম আসেনি।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এমভি আফ্রিকান লায়ন নামে একটি জাহাজ কানাডা থেকে ৬৫ হাজার টন গম নিয়ে বন্দরের বহির্নোঙরে এসেছে। চলতি সপ্তাহে জাহাজটি থেকে গম খালাসের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কানাডা থেকে আসা গমগুলো উচ্চমানের শক্ত গম। আমাদের দেশে আটা-ময়দা তৈরির জন্য বেশিরভাগ নরম গম ব্যবহার করা হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের বুকিং রেট কিছুটা কমেছে। তবে ডলারের দাম বেশি হওয়ার কারণে আমদানি খরচ কমছে না।

খাতুনগঞ্জের গম ব্যবসায়ী আবু তৈয়্যব বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে কোনো গম আমদানি হচ্ছে না। বন্দরেও এতদিন গমের কোনো জাহাজ ছিল না। বেসরকারি শিল্পগ্রুপগুলোও গত দুই মাসে গম আমদানি করেনি। এখন বাজারে যে আটা-ময়দা আছে, সেগুলো দুই মাস আগে আসা গমের তৈরি। খাতুনগঞ্জে গমের দাম তেমন কমছে না। সামনের দিনগুলোতে কী হয় তা বোঝা যাচ্ছে না।’

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ভারত থেকে গম আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। তবে যেগুলো এলসি হয়েছে, সে গমগুলো আসছে। এখন কানাডা থেকেও গমের জাহাজ এসেছে। দেশের শিল্পগ্রুপগুলোর কাছে গমের ভালো মজুত রয়েছে। এতে সামনের দিনগুলোতে দাম বাড়ার তেমন আশঙ্কা নেই।’

তিনি বলেন, ‘ভারতীয় গম নরম জাতের। ভারতীয় গমের সঙ্গে কানাডার গম মিশিয়ে ভালো মানের ময়দা তৈরি করা হয়। এখন খাতুনগঞ্জসহ দেশের বাজারে দুই দেশের গমই পাওয়া যাচ্ছে।’

খাতুনগঞ্জের গম ব্রোকার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মেসার্স আল মাওয়া করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বর্তমানে ভারতীয় গম বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণ ১৪৬০ টাকায়। দুদিন আগে বিক্রি হয়েছিল ১৪৫০ টাকায়। গত ১৫ দিন আগে আরও কম ছিল ভারতীয় গমের দাম। তবে কানাডা থেকে আসা গমের দাম বর্তমানে কিছুটা কম থাকলেও ১৫ দিন আগে বেশি ছিল। বর্তমানে খাতুনগঞ্জের বাজারে প্রতিমণ ১৯৫০ টাকায় গমের ডিও বিক্রি হচ্ছে।’

এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে গমের বুকিং রেট কমেছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে ডলারের দাম ১১০ টাকার মতো। এতে আমদানি খরচ বাড়ছে। ফলে স্থানীয় বাজারে গমে দাম কমছে না।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের বাজারে আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দাম কমান না। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের বুকিং রেট কমেছে। কিন্তু আমাদের দেশে আগের সেই বেশি দামেই আটা-ময়দা বিক্রি হচ্ছে।’

সূত্র: জাগো নিউজ