এক বছরেই বদলে যাবে ঢাকা, কমবে যানজট

ফানাম নিউজ
  ০৬ অক্টোবর ২০২১, ১২:৪৮

২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার গণপরিবহনে যুক্ত হবে মেট্রোরেল। এ বছরের ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলক চালু হচ্ছে বাস রুট রে‌শনালাইজেশন। কাজ চলছে সার্কুলার ট্রেনেরও। রয়েছে পাঁচটি ফ্লাইওভার। নির্মাণ হবে আরও দুটি। ঢাকার চারদিকে হবে বৃত্তাকার রেলপথ। জল-সড়ক-রেল নিয়ে সরকারের রয়েছে ত্রিমুখী পরিকল্পনা। সব মিলিয়ে নগরের পরিবহন ব্যবস্থা আমূল বদলে যাবে বলে জানালেন নগরবিদরা। তারা জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানীতে যানজটই থাকবে না।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে রাজধানী। ঢাকাকে নিয়েই যত বিশেষ পরিকল্পনা।

মেট্রোরেল

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ৬টি এমআরটি লাইন নির্মাণ করা হবে। লাইন-৬ এর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এই লাইনে ট্রেন চলবে। উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও শাহবাগ হয়ে মতিঝিল যাবে।

প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটারের এই পথে ১৬টি স্টেশন থাকবে। এরই মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। এই পথে উভয় দিকে এক সঙ্গে ৫ লাখ যাত্রী চলাচল করবে।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘মেট্রোরেল এখন অবাস্তব কিছু নয়। নগরবাসী এরই মধ্যে এটি দেখতে শুরু করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবগুলো লাইন বাস্তবায়িত হলে ঢাকার যানজট কমে যাবে। পরিবেশেও অসামান্য প্রভাব পড়বে৷ জিডিপিও বেড়ে যাবে এক শতাংশ।’

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামসুল হক বলেছেন, ‘এটি বিশ্বজুড়ে নগরের সর্বাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা৷ আমাদের এই জনবহুল শহরে আরও আগেই দরকার ছিল। এটি শুধু পরিবহন খাতের উন্নয়ন প্রকল্প নয় বরং একটা নগর পরিকল্পনার গাইডলাইন।’

মেট্রোরেলের আরও নেটওয়ার্ক

লাইন-৫: এ লাইনের মাধ্যমে দুটি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি সাউথ (দক্ষিণ) রুট ও অন্যটি নর্থ (উত্তর) রুট। উত্তর রুটের আওতায় ২০২৮ সালের মধ্যে উড়াল ও পাতাল রেলের সমন্বয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার লাইনের নির্মাণকাজ শেষ হবে। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে পূর্বের ভাটারা থানা পর্যন্ত রুটটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

লাইন-৫ এর দক্ষিণ রুট: এই রুটে স্টেশন থাকবে ১৪টি—৯টি পাতাল ও ৫টি উড়াল। এ রুটের শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে— হেমায়েতপুর-বালিয়ারপুর, মধুমতি-আমিনবাজার, গাবতলী-দারুস সালাম-মিরপুর ১- মিরপুর ১০-মিরপুর ১৪-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২-নতুনবাজার-ভাটারা।

লাইন-৫ এর সাউথ রুট: এর মাধ্যমে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত পাতাল রেল ও উড়াল রেলের সমন্বয়ে ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার পথে থাকবে ১৬টি স্টেশন। এ অংশে ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার পাতাল ও ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার উড়াল রেল থাকবে। এ রুটের শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে—গাবতলী-টেকনিক্যাল-কল্যাণপুর-শ্যামলী-কলেজগেট-আসাদগেট-রাসেল স্কয়ার-পান্থপথ-সোনারগাঁও মোড়-হাতিরঝিল-নিকেতন-রামপুরা-আফতাব নগর-পশ্চিম আফতাবনগর সেন্টার আফতাব নগর পূর্ব-দাশেরকান্দি।

এমআরটি লাইন-২: এর আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলিভেটেড সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ লাইনের সম্ভাব্য শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে— গাবতলী-বসিলা-মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড-সাত মসজিদ রোড-ঝিগাতলা-ধানমণ্ডি ২ নম্বর রোড- সায়েন্সল্যাব-নিউমার্কেট-নীলক্ষেত-আজিমপুর-পলাশী-শহীদ মিনার-ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ-পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স-গোলাপশাহ মাজার-বঙ্গবাজারের উত্তর পাশের সড়ক-মতিঝিল-আরামবাগ-কমলাপুর-মুগদা-মেরা-চট্টগ্রাম রোড।

এমআরটি লাইন-৪: ২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্র্যাকের নিচ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া মেট্রোরেল রুট-১ এর আওতায় প্রায় ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ রুটে থাকছে দু’টি অংশ। প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন। দ্বিতীয় অংশ নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত।

বিমানবন্দর রুটে ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার জুড়ে বাংলাদেশের প্রথম পাতাল রেল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এতে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থাকবে ১২টি।

ত্রিমুখী পরিকল্পনা

বাস রুট রেশনালাইজেশনের মাধ্যমে যানজট নিরসনে বেশ কিছু পরিকল্পনা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান ড্যাপ-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বয় নিশ্চিত করা হবে।

প্রস্তাবিত সড়ক, নৌপথ ও রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক যোগাযোগের মাধ্যম জলপথ এবং ভারী যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে রেলপথ নিয়ে পুরো নেটওয়ার্ক সাজানো হচ্ছে। মানুষের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে পরিবহন নেটওয়ার্কের এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ড্যাপ পরিচালক।

নৌপথ

ড্যাপ এলাকায় ১ হাজার ৩২৬ দশমিক ৯ কিলোমিটার নদী ও খাল রয়েছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটির প্রশস্ততা ও নাব্যতা কম। কিছু খালে কালভার্ট ও বক্স কালভার্ট তৈরি করা হলেও এগুলো নৌযান চলাচলের উপযোগী নয়। এ অবস্থায় ড্যাপের প্রায় সাড়ে ৫৬৬ কিলোমিটার নৌপথকে শ্রেণিক্রম অনুসারে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—আন্তঃআঞ্চলিক, অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক ও সংগ্রাহক নৌপথ। বাকি খালগুলো নৌ চলাচলের অনুপযোগী ও সরু। তাই ২য় পর্যায়ে খালগুলোকে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় ৭৬০ কিলোমিটার চলাচলের একেবারেই অনুপযোগী। নৌপথকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উপযোগী করতে প্রথমে শ্রেণি ক্রমে ভাগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে কার্যকারিতা ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে তা নৌযান চলাচলের উপযোগী হবে।

রেলপথ

ঢাকার যানজট কমাতে শহরের চারপাশে একটি বৃত্তাকার রেলরুট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮১ দশমিক ৯ কিলোমিটার বৃত্তাকার ট্রেন নেটওয়ার্ক, উন্নত রাস্তা এবং দুই লাইনবিশিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড গেজ থাকবে। বৃত্তাকার রুটে ২০টি স্টেশন থাকবে। স্টেশনগুলো হচ্ছে−টঙ্গী, তেরমুখ, পূর্বাচল সড়ক, বেরাইদ, কায়েতপাড়া, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, চৌধুরীবাড়ী, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, শ্যামপুর, সদরঘাট, বাবুবাজার, নবাবগঞ্জ, শংকর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা, বিরুলিয়া, উত্তরা ও ধৌড়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই পথের ট্রেন ক্রমাগত উভয় পাশে চলাচল করবে।

ড্যাপের পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকার সঙ্গে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও নৌপথের গভীর সম্পর্ক। কিন্তু আমরা এর বাস্তবরূপ দিতে পারিনি। তাই তিনটি মাধ্যমের সমন্বয় করে ড্যাপে পরিবহন নেটওয়ার্কের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমরা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় জলের নেটওয়ার্ককে উপেক্ষা করেছি। খালে বক্স-কালভার্ট করে দিয়েছি। খাল ও নদীর যে ঐতিহ্য তা হারিয়ে ফেলেছি। এখন যেটুকু আছে তা দিয়েও অনেক কিছু করা সম্ভব। তাই বলবো- ড্যাপের এই প্রস্তাব অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে শুধু প্রস্তাবে আটকে থাকলে হবে না। বাস্তবায়নও করতে হবে।’

বাসরুট রেশনালাইজেশন

এটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে ঘাটারচর থেকে কাচপুর রুটে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে। প্রাথমিকভাবে ১২০টি নতুন বাস নিয়ে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে যাত্রা শুরু করবে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের স্বপ্নের প্রকল্পটি।

বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি ও ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আগামী ১ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এই রুটের উদ্বোধন করবেন।

বিআরটি প্রকল্প

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার পথে নির্মাণ চলছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প৷ এই পথে বাসের জন্য আলাদা লেন থাকবে। যেখানে ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে৷ প্রকল্পটি ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা আছে। তবে এর অগ্রগতি নিয়ে নানা মহলে রয়েছে অসন্তোষ।

ফ্লাইওভার

এলাকাভিত্তিক যানজট নিরসনে নগরীতে পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার, মহাখালী ফ্লাইওভার, মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার ও বনানী ফ্লাইওভার। এ ছাড়া আমিনবাজার-পলাশী ও শান্তিনগর-ঝিলমিল রুটে দুটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন