টাকা দিলে টিকা মেলে

ফানাম নিউজ
  ০৬ অক্টোবর ২০২১, ১১:১৫

করোনার টিকা নিতে আসা মানুষের দীর্ঘ লাইন। বেশির ভাগই নিবন্ধনের পর এসএমএস পেয়ে টিকা নিতে এসেছেন। লাইনের বাইরে কিছু মানুষ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কাউকে যেন খুঁজছেন। তাঁদের কয়েকজন আলাদা আলাদা গিয়ে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে ফিসফাস করছিলেন। এমনই একজন মোবাইদুল হক (২৫)। আগের রাতে নিবন্ধন করে এসএমএস ছাড়াই এসেছেন টিকা নিতে। পরে আনসার সদস্য ও দালালের মাধ্যমে রফা হয়। দুই হাজার টাকায় তিনি সিনোফার্মের টিকা নেন।

গত সোমবার সকালে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। ওই দিন টিকা নেওয়ার পর মোবাইদুলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, নিবন্ধন করলেও এসএমএস আসতে অনেক সময় লাগে। তাই ‘বিশেষ উপায়ে’ টিকা পেতে তিনি কামাল নামে এক আনসার সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। ওই আনসার সদস্য তাঁকে রাতে ফোন দিতে বলেন। এ সময় সাইফুল ইসলাম নামে এক দালাল তাঁকে ডেকে নেন। সবকিছু জেনে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, আজই এসএমএসের সঙ্গে টিকাও পাবেন। দুই হাজার টাকা লাগবে। তিনি কিছু কমানোর অনুরোধ করলে সাইফুল বলেন, এ টাকা শুধু তাঁরা নেন না। টিকাদানে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের এর অর্ধেক দিতে হয়।

মোবাইদুল বলেন, কিছুক্ষণ পরই হাসপাতালের ২ নম্বর গেট দিয়ে রেড ক্রিসেন্টের এক স্বেচ্ছাসেবক তাঁকে ভেতরে ডেকে নিয়ে টিকা কার্ডে সিল মেরে সোজা বুথে নিয়ে যান। বলেন, এখন টিকা নেবেন, সন্ধ্যায় এসএমএস পেয়ে যাবেন। টিকা দেওয়ার পর তিনি দালাল সাইফুলকে প্রতিশ্রুতির দুই হাজার টাকা দেন।

মোবাইদুল চলে যাওয়ার পর সৌদি আরব প্রবাসী ইয়াসিনকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন দালাল সাইফুল। তবে টিকার জন্য তিনি কত টাকা দিয়েছেন—জানতে চাইলে ইয়াসিন বলতে রাজি হননি। এর আগের দিনও ওই হাসপাতালে একই অবস্থা দেখা যায়। ওই দিন দুই হাজার টাকায় ফাইজারের টিকা নেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এনা পরিবহনে কাজ করা আজাদ শেখ (২৬)। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, টিকার জন্য গত ১৮ সেপ্টেম্বর নিবন্ধন করেছিলেন। দ্রুত টিকা পেতে পরিচিত একজনের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে আসেন। দায়িত্বরত আনসার সদস্য রুবেল দুই হাজার টাকার বিনিময়ে টিকার ব্যবস্থা করে দেন। বিষয়টি যাচাই করতে আনসার সদস্য রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, দুই হাজার ৫০০ টাকা লাগবে। দুদিনের মধ্যে তিনি টিকার ব্যবস্থা করে দেবেন।

­ওই দিনই বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদের সঙ্গে কথা বললে তিনি তাৎক্ষণিক তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পান। তিনি রুবেলসহ এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান। 

গত সোমবার হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রুবেলকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো একাধিক আনসার সদস্য এভাবে টিকা দেওয়ার চক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

দায়িত্বরত আনসার সদস্য কামাল বলেন, টিকার মেসেজ তাঁর সহকর্মী রুবেলই দেখতেন। বিষয়টি জানাজানির পর সমস্যা হচ্ছে। তাঁকে এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন তাঁর মাধ্যমে টিকা পেতে হলে রাতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

ডা. ফারুক আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘বিষয়টি বনানী থানায় জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়েও বিষয়টি জানাচ্ছি।’ তিনি স্বীকার করেন, তিনি নিজে গত সোমবার সকালে এক দালালকে ধরে পুলিশে দিয়েছেন। প্রতারকদের ধরতে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দারাও কাজ করছেন। 

জানা গেছে, শুধু গ্যাস্ট্রোলিভার নয়, ফাইজারের টিকা দেওয়া রাজধানীর সাতটি কেন্দ্রেই এমন নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। মিটফোর্ড হাসপাতালেও এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই চক্রের প্রভাবশালী একজন রনি। তিনি শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে কাজ ///////////////////////////////////(কী কাজ) ////////////////////////////করলেও সাতটি কেন্দ্রেই তাঁর লোক রয়েছে। টিকা পেতে তাঁকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দেন সৌদি প্রবাসী আলম মৃধা। গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিবন্ধন করে আগামী ১১ অক্টোবর টিকা নেওয়ার এসএমএস পান। এর আগেই গত রোববার টিকা পেতে অনেক চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। 

রনির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ফাইজারের টিকা দেওয়া প্রতিটি কেন্দ্রে আমাদের লোক আছে। শুধু টিকা নয়, চাইলে কোনো টিকা ছাড়াই সনদের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। এ জন্য খরচ হবে ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা।’ 

টিকা বিতরণ কর্মসূচির সদস্যসচিব ডা. শামসুল হক বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। টিকার জন্য যিনি টাকা দেবেন ও নেবেন—দুজনই দোষী। আমরা বিষয়টি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে জানাচ্ছি।’

টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘টিকার ব্যবস্থাপনাটা ঠিকভাবে করা যাচ্ছে না বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, সে পরিমাণ টিকা দেওয়া যাচ্ছে না। এটা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার একটা সমস্যা। দ্বিতীয়টি হলো, টিকার সরবরাহ অনুযায়ী নিবন্ধন করা হয়নি। এটা আগে চিন্তা করা উচিত ছিল যে আমরা কত টিকা পাব, সে অনুযায়ী আমরা কাদেরকে নিবন্ধন করতে দেব। টিকার সরবরাহ অনুযায়ী যদি নিবন্ধন করা যেত, তাহলে আর এই সমস্যাটা হতো না।’ সূত্র: আজকের পত্রিকা